ধরা পড়ছে তামিম-জিয়ায় নানা রহস্য

গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার দুই মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী এবং চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার অবস্থান নিয়ে রহস্য কাটছে না। ঢাকায় তাদের অবস্থান নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর ধারণা থাকলেও বিলম্বিত হচ্ছে গ্রেফতার। এজন্য যত দিন পার হচ্ছে জনমনে ততই নানা সন্দেহের ডালপালা বিস্তার লাভ করছে। এ রকম শংকার মধ্যে বৃহস্পতিবার পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সহসা ধরা পড়তে পারে তামিম। তবে জিয়ার অবস্থান নিয়ে তারা এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। গুলশান হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের অবস্থান নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। মারজান দ্রুত গ্রেফতার হওয়ার কথা থাকলেও সেটিও দুরাশায় পরিণত হয়েছে।

সূত্র বলছে, আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করছেন চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। আর নিউ জেএমবির প্রধানের দায়িত্বে আছে তামিম। এ দু’জনই দেশে আছে বলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বললেও তাদের আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় জিয়ার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। সবশেষে প্রকাশক দীপন হত্যায় গ্রেফতার হওয়া অন্যতম আসামি শামীমের কাছ থেকে জানা গেল, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পেছনেও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জিয়া। তিনি নাকি খুনিদের প্রশিক্ষকও। কিন্তু ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার না হওয়ায় নানান গুজব জনমনে জায়গা করে নিচ্ছে। এদিকে জিয়া, তামিম ও মারজানকে দ্রুত গ্রেফতারের বিষয়ে এখনও আশাবাদী কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে যা যা করণীয় তার সবই করা হচ্ছে। এজন্য প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

অবশ্য একটু জোরালো আশাবাদের কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘তামিম ও জিয়াকে ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে তামিমকে অল্প সময়ের মধ্যে হাতের নাগালে পাওয়া যেতে পারে।’

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, তামিম ও জিয়া ছাড়াও তাদের মতোই নিউ জেএমবির হাইপ্রোফাইল আরও কয়েকজন জঙ্গিকে শনাক্ত করা গেছে। এদের মধ্যে রিপন নামে এক জঙ্গি ভারতে পালিয়ে যায়। বর্তমানে সে ঢাকার সন্নিকটে অবস্থান করছে। তাকে সেখান থেকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ নাম প্রকাশ না করে প্রতিবেদককে বলেন, কোনো মামলার তদন্ত চলাকালে আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সব সময় সবকিছু বলা সম্ভব হয় না। এটিই নিয়ম। কেননা, যে তথ্য প্রকাশ করার মতো এখনও সময় আসেনি, তা যদি আগাম বলে দেয়া হয় তাহলে তদন্ত যেমন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে, তেমনি অনেক সময় টার্গেটকৃত আসামিকে ধরাও সম্ভব হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এটা ঠিক যে, যেহেতু আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, তামিম ও জিয়া ঢাকায় আছে। তাই স্বভাবত প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এদের আটকে বিলম্ব হচ্ছে কেন। তারা ঢাকার কোথায় আছে? আবার এ দু’জনের মধ্যে কেউ যদি দেশের বাইরেও থাকে, তাহলে কোন দেশে আছে সেটিও প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন ইত্যাদি। তিনি মনে করেন, উত্তর একটাই- তদন্ত সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। তিনি বলেন, কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতা কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে অনেকে যেমন প্রশ্ন তুলতে পছন্দ করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা ও আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে বহু ঘটনা ঘটতে পারে না। তবে এ কথা সত্য যে, জঙ্গি তৎপরতার এসব মাস্টারমাইন্ডকে আইনের আওতায় আনার পরই সব রহস্য কেটে যাবে। জানা যাবে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্যও।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে মাস্টারমাইন্ড তামিম ঢাকায় অবস্থান করছে। কিন্তু জিয়ার বিষয়টি নিয়ে এখনও তারা অনেকটাই সন্দিহান। এ অবস্থায় জিয়া ঠিক কোথায় আছেন তা আরও কিছুদিন রহস্যের জালে আটকে থাকতে পারে। তবে গোয়েন্দা অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ঢাকা ছাড়া দেশের বাইরেও তথ্য বিনিময় করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) সঙ্গে এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদান চলছে।

সূত্র জানায়, জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক। প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদানও হচ্ছে। এমনকি পালিয়ে থাকা কোনো গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি দিল্লির আইনশৃংখলা বাহিনী আটক করলে তা ঢাকার কাছে তুলে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে আসামি গ্রেফতার, অবস্থান ও তদন্ত সংক্রান্ত স্বার্থে অনেক তথ্য গোপন থাকতে পারে। সূত্রটি জানায়, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর রিপনসহ দুই কমান্ডার ভারতে পালিয়ে যায়। সম্প্রতি রিপন দেশে প্রবেশ করে। এ সময় সে গোয়েন্দা জালে আটকে যায়। এ অবস্থায় যে কোনো সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে গ্রেফতার করার খবর আসতে পারে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র আরও জানায়, নিউ জেএমবির একাংশের নেতা তামিমের দেশে থাকার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সে সহসাই ধরা পড়তে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি একেএম শহীদুল হক উল্লিখিত দুই মাস্টারমাইন্ডকে ধরিয়ে দিতে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, যারা তাদের (তামিম ও জিয়া) বিষয়ে তথ্য দিয়ে অবস্থান জানাবে তাদের এই পুরস্কার দেয়া হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুরস্কার ঘোষিত ব্যক্তিরা দেশেও থাকতে পারে, আবার দেশের বাইরেও থাকতে পারে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।

এর এক সপ্তাহ পর কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ‘আমাদের ধারণা- তারা ঢাকাতেই আছে। আমরাও চেষ্টা করছি এবং অন্য সবার কাছে সহযোগিতা চেয়েছি।’ জিয়া ও তামিমের বিষয়ে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশার পর জনমনে কিছুটা স্বস্তি দেখা দেয়। কিন্তু গ্রেফতার বিলম্বিত হওয়ায় এখন আবার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।-যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই