ধনী-গরিব বৈষম্যে দুনিয়া স্থায়ীভাবে ধ্বংস হবে : নাসার গবেষণা
শিল্পায়ননির্ভর এই বিশ্বসভ্যতা ‘স্থায়ী ধ্বংসের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মন্তব্য করে সম্প্রতি নাসার অর্থায়নে পরিচালিত প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা দলের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আগামী দশকগুলোতে প্রাকৃতিক সম্পদের অবিবেচক ব্যবহার ও ক্রমবর্ধমান হারে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়তে থাকার ফলে শিল্প-সভ্যতা এমনভাবে পতনের দিকে যাবে যে তাকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব না-ও হতে পারে। দ্য গার্ডিয়ান সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ গবেষণার কথা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে সংকটের একটি ‘পূর্ণ ঝড়ে’ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে ভেঙে পড়তে পারে। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ে নতুন একটি গবেষণা মডেলের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে এই গবেষণা। ‘হিউম্যান অ্যান্ড নেচার ডাইনামিক্যাল’ শিরোনামের এই মডেলকে সংক্ষেপে ‘এইচ এ এন ডি ওয়াই’ বা ‘হ্যান্ডি’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ফলিত গণিতবিদ্যার তাত্ত্বিক মার্কিন বিজ্ঞানী সাফা মোতেশারি প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
‘দুনিয়া ধ্বংসের’ এমন সতর্কতাকে প্রায়ই বিতর্কিত এবং চরমপন্থী মতামত বলে বিবেচনা করা হয়। তাই এ গবেষণায় বিভিন্ন কালের ঘটনাপঞ্জি থেকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে সভ্যতার উত্থান-পতন বাস্তবিক অর্থেই ইতিহাসের একটি নিয়মিত ঘটনা। এতে দেখা গেছে, অগ্রসর ও বহুমাত্রিক সভ্যতাগুলোও ধ্বংসের ঝুঁকিতে থাকে। তাই বর্তমান আধুনিক শিল্প-সভ্যতা কতটা টেকসই, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
‘রোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং তার চেয়ে বেশি না হয়ে থাকলেও সমভাবে অগ্রসর চীনের হান, ভারতের মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যসহ মেসোপটেমিয়ার মতো আরও অনেক অগ্রসর সভ্যতাও এই সাক্ষ্যই দেয় যে, অগ্রসর, উন্নততর, বহুমাত্রিক এবং সৃষ্টিশীল সভ্যতাও ভঙ্গুর এবং অস্থায়ী হতে পারে।’
ইতিহাসের এসব ঘটনায় ‘মানুষ ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে’ বোঝার চেষ্টা করে এই গবেষণায় সভ্যতার পতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোকে চিহ্নিত ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই বিবেচনায় আজকের শিল্প-সভ্যতার সামনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলো হলো— জনসংখ্যা, জলবায়ু, পানি, কৃষি ও জ্বালানি।
ঝুঁকির এ বিষয়গুলো পরস্পরের প্রতিক্রিয়ায় একই সঙ্গে দুটি মারাত্মক সামাজিক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করে। একটি হলো প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বা অতি-ভোগে ‘পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া’ এবং অন্যটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধনীদের সম্পদের বৈষম্যের মধ্য দিয়ে সমাজে ‘চরম অর্থনৈতিক স্তর বিন্যাস’ সৃষ্টি হওয়া। গবেষকেরা বলছেন, পাঁচ হাজার বছর ধরে সভ্যতার পতনের ব্যাকরণে এই দুটি সামাজিক পরিস্থিতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান দুনিয়ায় সম্পদ বৈষম্য বা চরম মাত্রার অর্থনৈতিক স্তর বিন্যাসই প্রাকৃতিক সম্পদের অতি-ভোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আর মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোতে থাকা ‘এলিট’ বা ‘অভিজাত’রাই এই অর্থনৈতিক-বৈষম্য এবং সম্পদের অতি-ভোগের জন্য সরাসরি দায়ী।
‘উদ্বৃত্ত সম্পদ সমাজগুলোতে সমভাবে বণ্টন তো করা হয়ই না বরং অভিজাতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মিলে এই সম্পদ উত্পাদন করলেও উত্পাদিত সম্পদের খুব অল্প একটা অংশই তাঁদের মধ্যে বণ্টন করে দেন অভিজাতরা। এভাবে সম্পদের যে ভাগ তাঁরা পান তা দিয়ে সাধারণ মানুষ কোনোরকমে কেবল জীবনধারণই করতে পারে, আর কিছু নয়।’
প্রযুক্তি একসময় আরও বেশি সক্ষমতা দিয়ে দুনিয়ার ধ্বংস ঠেকিয়ে দেবে বলে যাঁরা তর্ক করেন, এই গবেষকেরা তাঁদের মতকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁরা বলেছেন— ‘প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও দক্ষতা বাড়াতে পারে। কিন্তু তা একই সঙ্গে সম্পদের মাথাপিছু ভোগ এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের মাত্রাকেও বাড়িয়ে দেবে। তাই নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থার অভাবে কেবল প্রযুক্তির উন্নতি দিয়েই সম্পদের ব্যবহার কমানো যাবে না।’
গবেষকেরা দেখিয়েছেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নাটকীয় উন্নতি লাভের পরও দুই শতাব্দী ধরে কৃষি এবং শিল্পে উত্পাদনশীলতা ক্রমাগত বেড়েছে ‘সম্পদের অতি ব্যবহারের’ মধ্য দিয়েই, ‘সম্পদের ব্যবহার কমার’ মধ্য দিয়ে নয়।
বহুমাত্রিক নানা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ফলিত গণিতবিদ্যার তাত্ত্বিক সাফা মোতেশারি এবং তাঁর সহকর্মীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ‘আজকের দুনিয়ার নিবিড় পর্যবেক্ষণে এই বাস্তবতাই প্রতিফলিত হচ্ছে যে ধ্বংস এড়ানোর কোনো উপায় নেই।’ তাঁদের মতে, বর্তমান সভ্যতার এসব পরিস্থিতির মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মনে হতে পারে পরিস্থিতিটা দীর্ঘদিন ধরে একই রকমই আছে। কিন্তু অল্পসংখ্যক মানুষ মিলে যাত্রা শুরু করলেও ঘটনাক্রমে অভিজাতরাই এত বেশি সম্পদ ভোগ করেন যে, তাতে সাধারণ মানুষ দুর্ভিক্ষে পতিত হয় এবং এই দুর্ভিক্ষ থেকে একটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। এটা খেয়াল করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ ধরনের সম্পদ-বৈষম্য থেকে সৃষ্টি হওয়া দুর্ভিক্ষ শ্রমিক শ্রেণীর ধ্বংস ডেকে আনে, প্রাকৃতিক ধ্বংস নয়।
গবেষণাটিতে ধনী-গরিব সম্পদ বৈষম্যের পরই যে পরিস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমাগত আহরণজনিত সংকট। গবেষকেরা বলছেন, সাধারণ মানুষেরা যখন খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায় তখনও অভিজাতরা বিকশিত হতে থাকে। একসময় সাধারণ মানুষ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং সবশেষে বিলুপ্ত হয় অভিজাতরা।
ওপরের উভয় পরিস্থিতিতেই এটা স্পষ্ট যে, সম্পদের ওপর অভিজাতদের একচেটিয়া মালিকানার কারণেই মারাত্মক পরিবেশগত দুর্যোগেও সাধারণ মানুষদের চেয়ে অনেক পরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অভিজাতরা। গবেষকেরা বলছেন, এ বিষয়টি দিয়েই খুব ভালোভাবে ইতিহাসে নানা সভ্যতার পতনের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ধ্বংসে ‘অবিশ্বাসী’ বা ‘অসচেতন’ অভিজাতরা কীভাবে ঐতিহাসিক বিপর্যয়গুলো ঘটতে দিয়েছে, তা এই মডেল থেকে স্পষ্ট। বিশেষত রোম এবং মায়া সভ্যতায় অভিজাতদের এই ভূমিকা প্রমাণিত।
বর্তমান সভ্যতার সংকটকে এই শিক্ষা দিয়ে ব্যাখ্যা করলে যা পাওয়া যায় তা হলো, ‘অনিবার্য ধ্বংসের বিষয়ে সতর্কতা জানিয়ে সমাজের কিছু মানুষ উচ্চকিত হওয়ার চেষ্টা করলেও এবং ধ্বংস রোধে কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি তুললেও প্রয়োজনীয় এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় উচ্চবিত্ত এবং তাদের সমর্থকেরা। টেকসই পথে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে প্রায় কিছুই না করে উচ্চবিত্তরা বরং তাদের স্থিতাবস্থাতেই থাকতে চায়।’
বর্তমান পরিস্থিতি মারাত্মক হলেও বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলছেন, টেকসই সভ্যতার দিকে এগোনোর পথ তৈরি করা না গেলেও যথাযথ নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধ্বংস এড়ানোর শেষ চেষ্টা করতে পারে দুনিয়ার মানুষ। আর সে লক্ষ্যে অত্যাবশ্যকভাবে যে দুটি বিষয় করতে হবে তা হলো— প্রথমত, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা এবং দ্রুতগতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমিয়ে নবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমানো।
মন্তব্য চালু নেই