দেড় যুগ ধরে শিকল বাঁধা দুই বোন

ছোট্ট একটি ঘরে প্রায় দেড় যুগ ধরে শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে দুই বোন পাপড়ি ও অনন্যাকে। কারণ তাঁরা মানসিক ভারসাম্যহীন আর প্রতিবেশীদের জন্য নাকি যন্ত্রণাদায়ক। তাঁদের যত্ন নেওয়ার কেউ নেই। পার না ঠিকমতো খাবার। ফলে অসহায় দুই বোন ভুগছেন পুষ্টিহীনতায়। পারিবারের আকুতি—চিকিৎসা আর নিয়মিত খাবার পেলে তাঁরা সুস্থ জীবন ফিরে পাবেন। কিন্তু কে দাঁড়াবে তাঁদের পাশে?

পাপড়ি (৩৩) ও অনন্যার (৩০) বাড়ি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের আদারভিটা গ্রামে। মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। এখন ছোট ভাই সম্রাট (১৯) দেখাশোনা করেন তাঁদের। আরেক ভাই মুশফিকুর রহমান (১৩) অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করত। অভাবের সংসারে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ।

গতকাল সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, আদারভিটা গ্রামে লাল মামুদ সরকার বাড়ি নামে পরিচিত। ওই গ্রামের মৃত আবদুল মান্নানের মেয়ে পাপড়ি ও অনন্যা। তাঁদের একটি ঘরে শিকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় চলে খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কাজকর্ম।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৯৯ সালে পাপড়ি খাতুন ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। এরপর ২০০১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় অনন্যা খাতুনের একই রকমের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাঁদের আচরণ দিন দিন অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁরা দুজনই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এতে করে তাঁদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাঁদের বাবা আবদুল মান্নান জামালপুরে পরিসংখ্যান ব্যুরো কার্যালয়ে ছোট পদে চাকরি করতেন। দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। দুই বোন প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি শুরু করেন। এ জন্য প্রতিবেশীদের নানা কথাও শুনতে হয় আবদুল মান্নানকে। এতে নিরুপায় হয়ে দুই মেয়েকে শিকল পরিয়ে ঘরে আটক রেখে লালনপালন শুরু করেন তিনি। শিকল পরানোর পর থেকে দুই বোন আরো বেশি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।

একপর্যায়ে বাবা আবদুল মান্নান ২০১০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান। এরপর ২০১৪ সালে তাঁদের মা শাহিনা পারভীনও মারা যান। ছোট দুই ভাইয়ের জীবনে শুরু হয় নতুন লড়াই। এর মধ্যে সম্রাট এখন ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর সামান্য আয়ে তাঁদের দুই বোনের লালনপালন ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

জানতে চাইলে সম্রাট মিয়া বলেন, ‘আমাদের বাবা একটি ছোট চাকরি করতেন। নিজের বলতে দেড় বিঘা কৃষিজমি রেখে গেছেন। অভাবের তাড়নায় তা অনেক আগেই বন্ধক রাখতে হয়েছে। পুরো সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। অনেক সময় খাবারও সংগ্রহ করতে পারি না। এর মধ্যে বোনদের চিকিৎসা করাব কিভাবে। শিকলমুক্ত করলে তাঁরা কারো ক্ষতি করতে পারেন! তাই তাঁদের শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখি। কেউ আমার দুই বোনের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলে আমরা চিরদিন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ’

পাপড়ি ও অনন্যার এক চাচা আবদুল হাই বলেন, ‘টাকার অভাবে দুই বোনের চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। ভালো চিকিৎসা করানো হলে অবশ্যই তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। তাদের চিকিৎসায় দেশের সহৃদয় দানশীল ও বিত্তবান ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। ’-কালের কণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই