দেশের মোবাইল ফোন তরঙ্গে নেটওয়ার্কে ভারতীয় প্রতিবন্ধকতা

ভারতের নেটওয়ার্কের কারণে দেশের মোবাইল ফোন তরঙ্গে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দেশী-বিদেশী শক্তিশালী সিন্ডিকেট অনুপ্রবেশ, মানব ও মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের শিলিগুড়ির কোনো এক অজানা উৎস থেকে এই তরঙ্গে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দুটি মোবাইল ফোন অপারেটর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে।

অভিযোগকারী অপারেটরদের সঙ্গে নিয়ে বিটিআরসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এতে প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা উৎস খুঁজে পাচ্ছেন না। সীমান্তে তরঙ্গ প্রতিবন্ধকতা এড়াতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাৎসরিক ভিত্তিতে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিটিআরসির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। বুধবার জাতীয় সংসদে প্রতিবেদনটি উত্থাপন করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় যত বিটিএস (বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন বা মোবাইল টাওয়ার) আছে তার সব কটির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার কারণে বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে বর্তমানে সীমান্তবর্তী এলাকায় টাওয়ার বসানোর অনুমতি দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে প্রতিবেদনটি শিগগির প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ছাড়া দেশের অবশিষ্ট সীমান্ত ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রকৃতিগত কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক বেতার তরঙ্গের ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় তরঙ্গ প্রতিবন্ধকতার আশংকা থাকে। এর আগে ২০১২ সালে সীমান্তবর্তী এলাকায় সেলুলার মোবাইল নেটওয়ার্কে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে প্রতিবন্ধকতা পাওয়া গিয়েছিল। যা ভারতের দূতাবাসকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে সীমান্তবর্তী বি-বাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর জেলায় এয়ারটেলের অনুকূলে বরাদ্দ করা তরঙ্গে প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ পাওয়া যায়। যা বিটিআরসির অনুসন্ধানে ভারতীয় মোবাইল অপারেটর রিলায়েন্স জিও’র কারণে হচ্ছে বলে নিশ্চিত হয়েছে।

এ ছাড়া রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নওগাঁ জেলায় গ্রামীণফোনের অনুকূলে বরাদ্দ করা তরঙ্গেও প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ পাওয়া যায়। বিটিআরসি ও গ্রামীণফোনের যৌথ তরঙ্গ পরিবীক্ষণে ওই প্রতিবন্ধকতা ভারতের শিলিগুড়ির কোনো অজানা উৎস থেকে আসছে মর্মে ধারণা পাওয়া যায়। বিষয়টি নিরসনে বিটিআরসি নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় নেটওয়ার্কের কারণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ও সমস্যা সমাধানে আলোচনার জন্য ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বিটিআরসির বৈঠক হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর জন্য প্রতিবন্ধকতার একটি বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে বিষয়টি আমলে নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই চিঠির অনুলিপি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকেও দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, কক্সবাজার জেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় দেশের কয়েকটি মোবাইল ফোন অপারেটরের নেটওয়ার্ক মিয়ানমারের ভেতরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে গেছে। এসব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মাদক বা চোরাকারবারি ও দুষ্কৃতকারীরা অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন স্থানেও ভারতীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ভারতীয় বেতার তরঙ্গের কারণে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা ঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছে না।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে- রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জাফলং, আখাউড়া, হিলি এলাকায় সীমানা পেরিয়ে এসেছে ভারতের ভোডাফোন, রিলায়েন্স ও এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অনেক স্থানে সীমানা পেরিয়ে যাওয়া মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধানে বিটিআরসি ২০০৫ সালের দিকে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তখন সফল হতে পারেনি।

এরপর ২০০৮ সালের ৪ মে সশস্ত্র বাহিনী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সম্মতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলার পৌরসভা এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির অনুমতি পায়। ওই সময় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভেতরে যাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে পার্বত্য তিন জেলার বরকল ও বাঘাইছড়ি ছাড়া সব উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনে অনাপত্তি জানানো হয়। সে ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ছাড়পত্র গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ২০১০ সালে বরকল ও বাঘাইছড়ি উপজেলায়ও মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনে অনাপত্তি জানায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ।

২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিটিআরসির ৫৩তম স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভায় বাংলাদেশের যে কোনো সীমান্তে জিরো লাইন পর্যন্ত নিরাপত্তা ছাড়াই কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে বিটিএস (বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন বা মোবাইল টাওয়ার) স্থাপনের সুপারিশ করা হয় এবং তা পরের সপ্তাহে বিটিআরসির ১১৯তম সভায় অনুমোদন হয়। একই সঙ্গে সীমান্তে বিটিএস স্থাপনের জন্য অনুমতি নেয়ার লক্ষ্যে এনএসআই, ডিজিএফআই ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়। এর ১০ দিন পর বিটিআরসির ১২০তম সভায় আগের সভার সিদ্ধান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার ক্ষেত্রে এটি কার্যকর হবে না মর্মে সংশোধন করা হয়।

ওই সময় মোবাইল ফোন অপারেটরদের যুক্তি ছিল, সীমান্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি কমিয়ে আনলে দেশের অনেক গ্রাহক মোবাইল ফোনসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ছাড়া সমস্যা সমাধানে ভারতেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তিন বছর আগে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি বিটিআরসিকে একটি জরিপ প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধানে বিটিআরসি এখন পর্যন্ত উপযুক্ত কোনো নীতিমালা বা নির্দেশিকা তৈরি করতে পারেনি।

সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অব্যাহত চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। বলা হচ্ছে, এমন বিশেষ পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী। গত বছর ১৭ অক্টোবর বিটিআরসির ২০০তম সভায় এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, এ সংক্রান্ত খসড়া নির্দেশিকা নিয়ে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান ডিজিএফআই, এনএসআই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে খসড়া নির্দেশিকাটি প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করবে।খবর যুগান্তরের।



মন্তব্য চালু নেই