দেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর পরামর্শ

সস্তা অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর নয়, বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে সমসাময়িক সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদসহ অভ্যন্তরীণ অপশক্তিকে মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন সেমিনার কক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদ আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। বর্তমান সরকারের ‘দিন বদলের ৭বছর’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী, প্রধান অতিথি ছিলেন এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। বিশিষ্টজনদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার তানিয়া ইসলাম, এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন, প্রাক্তন বিচারপতি সামসুদ্দিন মানিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, অর্র্থনীতিবিদ শামসুল আলম প্রমুখ। সেমিনার পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের উপ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।

এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে আজকে অনেক গর্ব করার বিষয় আছে। তবে আমাদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। ১৯৭১ সালে বিজয় লাভের পর আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বিজয় পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, তারা আত্মগোপনে থেকেই তাদের কাজ করে গেছেন। যার ফলে আমরা আজকে দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। এটা আমাদের রোধ করতে হবে। নইলে বাংলাদেশের মৌলিক লক্ষ্য ও যে সমস্ত ভিত্তির উপর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো অর্জিত হবে না।’

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক মতো গড়ে তুলে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘যে ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে বর্তমান সরকার এই সমস্ত অগ্রগতি সাধন করেছে, সে সমস্ত প্রতিকূলতা ভয়ানক ছিল, পাহাড়সম ছিল। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমরা সেখানে অগ্রসর হতে পেরেছি। সরকার সেখানে প্রয়োজনীয় যোগান দিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যেকে আমরা আশাবাদী হতে পারি।’

‘প্রফেসর আনিসুজ্জামান আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্রর যে কথা বলেছেন সেটি প্রত্যেকের বক্তব্যের মধ্যে এসেছে’ উল্লেখ করে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আজকে আমাদের এখানে জঙ্গিবাদের যে উত্থান দেখছি; এরা আর কেউ নয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ক্ষুদ্র একটি অংশ আমাদের বিরোধীতা করছিল তারা। এদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম এবং অতি ডানপন্থি পূর্র্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা গ্রুপ ও নকশালপন্থিরা। এরা একত্র হয়ে একাত্তরে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং নৃশংসতা করেছে। এরাই একাত্তরে জেনোসাইডের জন্য দায়ী। এই লুকিয়ে থাকা লোকগুলোকে নিয়েই পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘এই যে উত্থান হল, এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ২০১৩ সালের প্রথমে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন পেলাম। তারপরে হামলা। এরপর এসে বিএনপি-জামায়াতের ৯০ দিনের আন্দোলন। এগুলোর সবকিছুই একসূত্রে গাঁথা। এখানে যে যাই বলুক না কেন, আমি মনে করি এখানে আন্তর্জাতিক বলে কিছু নেই। কারণ, বিএনপি জামায়াত যে স্টেট টেরোরিজম সৃষ্টি করেছিল তার বহিঃপ্রকাশ এখনো আছে। জেএমবির এখন যারা ধরা পড়েছে এরা তাদেরই সাগরেদ। এদের মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর আছে এবং তারা কাজগুলো করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এর আগে গত ৯০ দিন বিএনপি-জামায়াত যে লোমহর্ষক কাজগুলো করেছে সেটি কিন্তু জনগণের প্রতিহতের কারণেই থেমে গেল। জনগণই তাদের হরতালে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এখনো তাই হবে। জনগণই তাদের ঠেকাবে। জনগণই তাদের পিষে ফেলবে এবং তাদের দিন শেষ হওয়ার সময় এসেছে।’

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের সদস্যসচিব হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আজকে যে অদম্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে তার মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং জঙ্গিবাদ নির্ভর রাজনীতি। বিশেষ করে আমাদের বিএনপি-জামায়াত যদি জঙ্গিবাদ নির্ভর রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারত তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা দেশকে আরো ধাবমান গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম।’

সাংবাদিক নেতা ও বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ইটিভির সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বিএনপির প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত করে বলেন, ‘যারা উন্নয়ন দেখতে চায় না, তারা উন্নয়ন দেখতে পাবেন না খুবই স্বাভাবিক।’

তিনি আরো বলেন, ‘উন্নয়নের শত্রু হচ্ছে দুই রকম। একটি হচ্ছে বাইরের শত্রু আরেকটি হচ্ছে ভিতরের শত্রু। বাইরের শত্রুদের আমরা চিনি। তাই আমাদেরকে ভিতরকার শত্রু সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এদেরকে মোকাবেলা করার জন্য আত্ম উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন মানবসম্পদ উন্নয়নকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে দারিদ্র কমছে এবং দারিদ্র অচিরেই ইতিহাসে পরিণত হবে। এটা অর্থনীতির গতিধারাতেই হবে। কিন্তু আমাদের দেশে অর্থনৈতিক মধ্যবিত্তের আকার বৃদ্ধি পেলেও জ্ঞানভিত্তিক মধ্যবিত্তের বিকাশ হচ্ছে না। আমরা যদি আমাদের দেশে আলোকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি না করতে পারি তাহলে আগামী দিনে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।’

রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে বইয়ের দোকানগুলোর চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সেখানে আগে ছিল বইয়ের দোকান এখন হয়েছে টেইলরিংয়ের দোকান। এটা আমাদের অর্থনীতির ২০ বছরে যা ঘটেছে তার একটি প্রতীকি চিহ্ন। আমরা মূলত সস্তা শ্রম নির্ভর একটি অর্থনীতির গতি সৃষ্টি করেছি। কিন্তু জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধির সমাজ দাঁড় করাতে পারি নি। তবে এটা করতে হবে।’

সরকারের সঙ্গে সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকদের দুরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান এই অর্থনীতিবিদ।



মন্তব্য চালু নেই