দূর্ঘটনা কবলিত সেই বিমানে বাংলাদেশের যাত্রীদের শ্বাসরুদ্ধকর ৫ ঘন্টায় কি হয়েছিল জানুন

বিকাল ৪টা থেকে রাত পৌনে ৯টা। প্রায় ৫ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়ানক মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন বাংলাদেশ বিমানের ২০৬ যাত্রী। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তারা। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

বাংলাদেশ বিমানের এয়ারবাস ৩১০ ফ্লাইট নং বিজি ০৮৫ সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শনিবার বিকাল ৪টায় উড্ডয়ন করে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে এয়ারবাসটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটির দ্বিতীয় ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। পাইলটরা বিমান থেকে প্রায় সব জ্বালানি তেল সাগরে ফেলে কিছু তেল রেখে আড়াই ঘণ্টা আকাশে চক্কর দেন। অবশেষে রাত পৌনে ৯টায় আংশিক জ্বলন্ত এয়ারবাসটি নিরাপদে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করানো হয়। এর আগে উড্ডয়নের ৪৫ মিনিট পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গী বিমানবন্দরে ফিরে যায় ওই এয়ারবাসটি।

দ্বিতীয় দফা উড্ডয়নের ঘণ্টা দেড়েক পর বিমানের দ্বিতীয় ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। পাইলটরা বিমানে থাকা স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করে আকাশেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। আগুনে বিমানটির ভেতরে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে খবর দেয়া হয় বিমানবন্দরের কন্ট্রোলরুমে। সেখান থেকে পুরো বিমানবন্দরে জারি করা হয় রেড-অ্যালার্ট। বিমানবন্দর ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলোকে নেয়া হয় রানওয়েতে। প্রস্তুত করা হয় অ্যাম্বুলেন্সসহ যাবতীয় উদ্ধারকারী দলকে। খবর দেয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলরুমে। অবতরণের পরও বিমানটির দরজা খুলছিল না। ফলে আরও ভয়ানক মৃত্যু যন্ত্রণা দেখা দেয় যাত্রীদের মধ্যে।

এয়ারবাসটির ওই ফ্লাইটে মূল পাইলট ছিলেন একজন ইয়ামেনী। তার নাম জানা যায়নি। ওই ইয়ামেনী পাইলট এক বছর আগে অবসরে যাওয়া ও সদ্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ক্যাপ্টেন শামসকে এয়ারবাসটি চালনোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। ২২১ আসনের বিমানটিতে যাত্রী ছিলেন মোট ২০৬ জন। বাকিরা পাইলট ও কেবিন ক্রু। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, বিমানের তেল না ফেলা হলে অবতরণের সময় বিমানটি বিস্ফোরিত হওয়ার আশংকা ছিল। এ কারণে বিমান থেকে সব তেল সাগরে ফেলে অবতরণ করানো হয়। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল এয়ারবাসটি চট্টগ্রামে অবতরণ করানো হবে। কিন্তু পরে এক ইঞ্জিনে ভর করে ঝুঁকিপূর্ণভাবেই সেটি ঢাকায় অবতরণ করানো হয়। রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের খবর পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা রাতে যুগান্তরকে জানান, সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণ চোরাচালান করা হয়। অনেক সময় বিমানের নাট-বল্টু খুলে ভেতরে স্বর্ণ ঢুকিয়ে পাচার করা হয়। সেরকম কেউ নাট-বল্টু খুলে ফেলার কারণেও ওই অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বিমানে থাকা যাত্রী ও কেবিন ক্রুরা চরম আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। অনেকে আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। মহিলা ও শিশুরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার আহাজারি করতে থাকেন। এ সময় বিমানের ভেতর এক ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাত পৌনে ৯টায় বিমানটি শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরের নর্থ-ফ্রস্ট জোনে অবতরণ করানোর পর বিমানে থাকা যাত্রীদের একে একে উদ্ধার করা হয়। বিমান থেকে যাত্রীরা বলেন, আমরা সবাই যেন নতুন জীবন পেলাম। তারা একে অপরকে এবং উপস্থিত আত্মীয়স্বজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিমানে আগুন লাগা প্রসঙ্গে যাত্রী জিয়াউদ্দিন বাবলু  বলেন, মনে হয় নতুন জীবন পেলাম। বিমানটি সিঙ্গাপুর থেকে উড্ডয়নের পরেই ত্রুটি দেখা দেয়। ৪৫ মিনিট পরে আবার সিঙ্গাপুরে ফিরে যায়। ত্রুটি মেরামত করে আবার আকাশে উড়ার পরও ইঞ্জিনের ত্রুটি দেখা দেয়। পাইলট নানা কসরত করে বাংলাদেশের আকাশে দুই আড়াই ঘণ্টা চক্কর দিয়ে যখন শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেন তখন অনেক সময় বিমানের দরজা খুলছিল না। এ অবস্থায় ভেতরে যাত্রীরা মৃত্যু ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন। কি যে মরণ যন্ত্রণা ও ভয়ানক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

অপর যাত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রাতে  বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে উড্ডয়নের সময় বলা হয়েছিল কম্পিউটারে সমস্যা। কিন্তু এই ত্রুটি নিয়ে ঘণ্টাখানেক পর ঢাকার শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগে একটি ইঞ্জিনে মারাত্মক ত্রুটি দেখা দেয়। পরে পাইলট বিমানটি ঘুরিয়ে ইঞ্জিনে ভর করেই অবতরণ করান।

বিমানের যাত্রী পুরান ঢাকার ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন  জানান, তিনি স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরছিলেন। বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমার কাছাকাছি আসার পর প্রথমে প্লাস্টিকের তার পোড়ার মতো গন্ধ পান। এ সময় এয়ারহোস্টেসরা সামনের দিকে চলে যান। এরই মধ্যে একজন প্রকৌশলী দৌড়ে পেছনে যান। কিছুক্ষণ পর লাউড স্পিকারে ঘোষণা দেয়া হয়, আমরা বাংলাদেশের আকাশ সীমায় পৌঁছে গেছি। বিমানের একটি ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। আপনারা কেউ আতংকিত হবেন না। আমরা সমস্যা সারানোর চেষ্টা করছি। আপনারা কেউ সিট থেকে উঠবেন না। সবাই আল্লাহকে স্মরণ করেন। বাংলা ও ইংরেজিতে এই ঘোষণার পর যাত্রীরা আতংকিত হয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকেন। কেউ কেউ আজানও দিতে থাকেন।





এ অবস্থায় বিমানের ভেতর ধোঁয়া দেখা দেয়। সবাই আরও বেশি আতংকিত হয়ে পড়েন এবং নিশ্চিত মৃত্যুর কথা চিন্তা করে কান্নাকাটি জুড়ে দেন। এভাবে ২ ঘণ্টার বেশি সময় পর বিমানটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার ঘোষণা দেয়া হয়। নামার সময় বিমানটি প্রচণ্ড ধাক্কা খায় এবং যাত্রীরা একে অপরের ওপর গিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর ধীরে ধীরে যাত্রীদের একে একে নামিয়ে আনা হয়। অপর যাত্রী সিঙ্গাপুর প্রবাসী সিলেটের আরিফুল ইসলাম জানান, বিমানের ভেতর ধোঁয়া প্রবেশ করতে থাকলে মনে হয়েছে, এই আমাদের জীবনের শেষ ক্ষণ। হয় তো আর কেউ বাঁচব না। বিমানে থাকা অবস্থায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা হয়। ৫ ঘণ্টার অচলাবস্থার পর অবতরণ শেষে বেরিয়ে মনে হল নতুন জীবন পেলাম।

বাংলাদেশ বিমান সূত্র জানায়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খবর পেয়ে ছুটে যান বিমানবন্দরে। সাইরেন বাজিয়ে বিমানবন্দর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো একের পর এক রানওয়েতে নেয়া হতে থাকে। খবরটি ওয়্যারলেসে দেয়া হয় এয়ারপোর্টের সর্বত্র। যাত্রীদের উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাউমাউ কান্না, চিৎকার ও আহাজারিতে বিমাবন্দরে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেকে ভয়ে আজান দিতে থাকেন। সবাই ভয়ে দাঁড়িয়ে যান। আশু বিপদের আশংকায় তাৎক্ষণিভাবে বন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ পর বিমানটি নিরাপদে নামার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত হয়। যাত্রীদের সবাইকে নিরাপদে নামাতে সক্ষম হয় বিমান কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, এয়ারবাস ৩১০ অনেক পুরনো, বিশ্বে যা অচল। ভালো এয়ার লাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর এয়ারবাস ৩১০ মডেলের উড়োজাহাজ যাত্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহার করে না। কার্গো উড়োজাহাজ হিসেবে কেউ কেউ এসব উড়োজাহাজ চালান। এই মডেলের উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও ৫০ ডলারের একটি যন্ত্রাংশ কিনতে ব্যয় হয়ে যায় হাজার হাজার ডলার।

সূত্র জানায়, ৫ বছর মেয়াদে লিজে আনা হয় এই এয়ারবাসটি। বিমানের বহরে এয়ারবাস ৩১০ উড়োজাহাজ যুক্ত হয় ১৯৯০ সালে। তখন কেনা দুটি বিমান ছিল নতুন। এর মধ্যে একটি দুবাইয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। কাছাকাছি সময়ে এই এয়ারবাসটি লিজ নিয়ে পরে কেনা হয়। এই বিমানটি প্রায় ২ মাস সিঙ্গাপুরের চাঙ্গী বিমানবন্দরে পড়েছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অপর একটি এয়ারবাস ৩১০ ফাটল ধরে। ওই সময় এই এয়ারবাসটিতে বড় ধরনের ক্ষতির আশংকা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এই বিমানটি ঢাকা-সিঙ্গাপুর রুটেই চলত।

অপর একজন যাত্রী বলেন, প্রায় ৩০ বছরের পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা একটি এয়ারবাস দিয়ে শত শত যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলা কি যুক্তিসঙ্গত? এটির বাথরুম ভালো নয়। হ্যান্ড লাগেজ বাংকার নড়বড়ে। সিটগুলো বাসের মতো চাপা। ভেতরের কন্ডিশনও ভালো না। জাতীয় পতাকাবাহী একটি এয়ারলাইন্সের এ ধরনের নিুমানের উড়োজাহাজে অবশ্যই যাত্রী পরিবহন করা উচিত নয়।

আরো পড়ুন :

বেঁচে গেলেন ২০৬ বিমানযাত্রী, ঢাকায় জরুরি অবতরণ



মন্তব্য চালু নেই