দুই ডিসিসিতে সেবা নেই, আছে ভোগান্তি
সেবার মান বাড়ানোর কথা বলে প্রায় তিন বছর আগে দু’ভাগে ভাগ করা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনকে। দফায় দফায় নিয়োগ করা হয় প্রশাসক। বাড়ানো হয় হোল্ডিং ট্যাক্স। বেড়েছে কর্মকর্তা- কর্মচারী, পদ-পদবি। বেতন-ভাতা। কিন্তু সেবার মান বাড়েনি এতটুকু। বরং, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেড়েছে হয়রানি ও দুর্ভোগ। ভেঙে পড়েছে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। বর্ধিত ট্যাক্স দিয়েও ন্যূনতম সেবা পাচ্ছেন না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। চরম দুর্ভোগ ভোগান্তির মধ্যেই বসবাস করছেন প্রায় সোয়া কোটি লোক। খানাখন্দে ভরা নগরীর রাস্তাঘাটের করুণ দশা। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, মশার উপদ্রব। জন্মনিবন্ধন থেকে মৃত্যুসনদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলছে দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি আর ভোগান্তি। টাকা ছাড়া মিলছে না নাগরিকতার সনদও। রাস্তাঘাট সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ সেবামূলক সব কাজ স্থবির হয়ে আছে। এক কথায় মেগাসিটির ঢাকার চারদিকে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। দীর্ঘ দিন নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় ডিসিসির এমন ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন কবে হবে, তাও কেউ জানে না। বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি শাখার প্রধান কর্মকর্তা বলেন, ডিসিসির বিভক্তি এ সরকারের একটি বড় ভুল হিসেবে ইতিহাস হয়ে থাকবে। কোন কৌশলে সরকার এই ভুল অস্বীকার করতে পারবে না। অবিভক্ত রেখে কেবল কয়েকটি আঞ্চলিক অফিস বাড়ালেই নাগরিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাত বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা। এদিকে সীমানা জটিলতা নিরসন করে খণ্ডিত ডিসিসি নির্বাচনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে বার বার তাগাদা দিয়েও কোন সমাধান পাচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। বর্তমান সরকারের বিগত মেয়াদে ডিসিসি নির্বাচন করতে না পারায়, এ মেয়াদেও নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন খোদ নির্বাচন কর্মকর্তারা। ডিসিসি দক্ষিণের একটি ওয়ার্ডের সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের কোনো সাড়া না পাওয়ায় এ শঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আইনি জটিলতায় দীর্ঘ ৭ বছর ধরে আটকে থাকা ডিসিসি নির্বাচন কবে নাগাদ হবে তা বলতে পারছে না কমিশন। এর আগেও কয়েক দফা প্রস্তুতি নিয়েও নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে এ সংস্থাটি। তবে কিছু দিন আগেও সরকারের উচ্চ ুমহলে ডিসিসি নির্বাচন আয়োজনে তোড়জোড় দেখা গেলেও তা আবার থেমে গেছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, সীমানা পুনঃনির্ধারণে কয়েকবার তাগিদ দিয়েও সরকারের কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ওদিকে সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই কিছু সেবা পেতে ওয়ার্ড অফিসগুলোয় ভিড় করেন নাগরিকরা। এর মধ্যে নাগরিকত্ব সনদ, জন্ম নিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশের সনদ, মৃত্যু সনদ, ছবি সত্যায়নের কাজেই বেশি আসেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ৯২টি ওয়ার্ডেই জনপ্রতিনিধি তথা কাউন্সিলর না থাকায় এখন এসব কাজের জন্য ভরসা করতে হয় ওয়ার্ডের সচিবদের ওপর। তবে অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না সচিবদের। সপ্তাহে এক-দু‘দিন তাদের পাওয়া গেলেও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। ঢাকা সিটির কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়েও দেখা মেলেনি সচিবদের। তবে অফিসে ভিড় করতে দেখা যায় সাধারণ নাগরিকদের। বিভিন্ন কাজে তারা এসেছেন। ওয়ার্ড সচিবরা না থাকায় তারা বসে আছেন। দালাল গোছের কিছু লোক আগতদের প্রশ্ন করছেন কি লাগবে? নাগরিকত্ব সনদ, না জন্ম সনদ? তবে তারা তাদের পরিচয় কাউকে দিচ্ছেন না। আর এভাবেই প্রতিদিন দালালের খপ্পরে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। প্রতিদিন শত শত লোক ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আর সেই সুযোগে কাউন্সিলর কার্যালয়গুলোয় নাগরিকত্ব সনদ ও জন্ম সনদ দেয়ার নামে একটি চক্র বাণিজ্য শুরু করেছে। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা নিয়ে দেয়া হচ্ছে একটি সনদ। সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবুল বাসার বলেন, সরকার রাজনৈতিক কারণে এ সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। সেবার মান বাড়ানোর কথা বলে নগরবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সেই প্রতারণার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। তিনি বলেন, নির্বচিত কাউন্সিলরা ডোর-টু-ডোর জনসংযোগ করার কারণে প্রায় সব ওয়ার্ডবাসীকে চিনতেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও একটা দায়বদ্ধতা ছিল। কিন্তু সচিবদের সে রকম কিছু নেই, থাকার কথা নয়। তাই স্বাভাবিক কারণে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। ওদিকে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম চালানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না বলে অনেকের অভিযোগ। প্রতিদিন মশক নিধন কার্যক্রম চলার কথা থাকলেও সরজমিনে ঘুরে কোথাও মশক নিধন কার্যক্রমের দেখা মেলেনি। এদিকে মশার উপদ্রব নগর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মশা দমন, মশক প্রজননস্থল যেমন ডোবা, নালা, বিল, ঝিল, নর্দমায় নিয়মিত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও সেসব বিষয় সিটি করপোরেশন শুধু বক্তৃতা, সেমিনার, লিফলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। উত্তরার বাসিন্দা মুকুল প্রধান বলেন, ‘মশক নিধনে সিটি করপোরেশন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এলাকায় দেড়-দু’বছরেও মশার ওষুধ ছিটানোর নজির দেখতে পাচ্ছি না। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আসে।’ নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির রাস্তাঘাটের করুণ দশা। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে পূর্ণ রাস্তাঘাট এখন রাজধানীর অন্যতম সমস্যা। বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পা রাখার যেন উপায় নেই। নানা সেবা সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেরামতের নামে সড়কে পিচ-সুরকি ফেলে রাখা আর পানি জমে কাদা-আবর্জনার সয়লাব রাস্তাঘাট যেন নাগরিকদের নিত্য সঙ্গী। বাড্ডা-ভাটারা এলাকার অনেক রাস্তা দিনের পর দিন একহাঁটু নোংরা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কোনটা রাস্তা আর কোনটা ড্রেন-নর্দমা তা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। সরজমিনে রাজধানীর সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান-বনানী, তেজগাঁও এলাকা ঘুরে বেশির ভাগ ওয়ার্ডে রাস্তাঘাটের খারাপ পরিস্থিতি দেখা গেছে। ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যার বিষয়ে নগরবাসী অভিযোগ করলেও কোন ফল মিলছে না। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারারও একই অবস্থা। দুই ডিসিসি কার্যালয় ঘুরে কোনোটিতেই সাবেক কাউন্সিলরদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অসাধু ব্যক্তিরা স্বাক্ষর জাল করে আগের তারিখে সনদ দিয়ে দিচ্ছেন। আবার কোন কোন কার্যালয়ের স্টাফরা ‘নগর ভবন’ থেকে সনদ স্বাক্ষর করিয়ে এনে দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে তারা নিচ্ছেন ৫০০ থেকে হাজার টাকা। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিলে। ২০০৭ সালের মে মাসে এর মেয়াদ শেষ হয়। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনও দু’দফা ভোটের উদ্যোগ নিলে আইনি জটিলতায় আটকে যায়। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বরে ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। পরের বছর ইসি দুই করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলেও আইনি জটিলতায় তা ফের স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৩ সালের মে মাসে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে নতুন করে তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। তবে সীমানা জটিলতায় নির্বাচন আবারও ঝুলে যায়। ফলে নাগরিক সেবা সাধারণের দোরগোড়ার পরিবর্তে আরও দূরে সরে গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ইবরাহিম হোসেন খান বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় দায়িত্ব পালন করেন প্রশাসকরা। তাই তাদের সঙ্গে নগরবাসীর তেমন সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। তবু আমরা সীমিত সময়ের মধ্যে নগরবাসীকে কাঙিক্ষত সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। এদিকে আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সম্পত্তি বিক্রি করে এই সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না সংস্থাটি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিল পরিশোধসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে কোন সময় অচল হয়ে যেতে পারে এ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাটি- এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট অনেকের।
মন্তব্য চালু নেই