জেলে মদন, দরবারে মমতা

দিদি তুম ক্যায়সে হো? শুনে অস্বস্তির হাসি

ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন “দিদি তুম ক্যায়সে হো (দিদি কেমন আছো)।” খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে এক চিলতে হাসি ফুটল মমতার ঠোঁটেও। হাত তুলে নমস্কার জানালেন। প্রতি নমস্কারে জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রীও। সব মিলিয়ে খুব বেশি হলে মিনিটখানেক। তার পরেই মমতার পাশে দাঁড়ানো মনমোহন সিংহের পত্নী গুরশরন কৌরের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে এগিয়ে গেলেন মোদী। মমতা ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সুষমার সঙ্গে গল্পে।

কিন্তু এই এক মিনিটই দিকচিহ্ন হয়ে রইল ভারতের রাজনীতিতে। কারণ, দীর্ঘ সাত মাস প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলার পরে অবশেষে তাঁর মুখোমুখি হলেন মমতা। সারদা কেলেঙ্কারির ছায়া ক্রমশ তাঁকে ও তাঁর দলকে ঘিরে ফেলার পরে এক প্রকার বাধ্যই হলেন বলে মনে করছেন রাজধানীর রাজনীতিকেরা। তাঁদের মতে, লোকসভা ভোটের ময়দানে দাঁড়িয়ে যে মোদীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পোরার হুমকি দিয়েছিলেন, এখন প্রবল বিপাকে পড়ে তাঁর উদ্দেশেই শান্তির বার্তা দিতে চাইছেন মমতা। সেই কারণে কলকাতায় বসে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্না দেওয়ার হুমকি দিলেও দিল্লি এসে সে ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। উল্টে সব কাজ ফেলে রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে হাজির হতে একটা দিন বেশি থেকে গিয়েছেন রাজধানীতে। সেখানে মোদীর সঙ্গে দেখা হবে, সেটা বিলক্ষণ জেনেই।

আব্দুল হামিদের সম্মানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া নৈশভোজে যাওয়ার আগে মমতা বলেন, “এক জন আমন্ত্রিত হিসেবেই আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি। সেখানে উপস্থিত যে কোনও আমন্ত্রিতের সঙ্গে কথা বলতেই আমার কোনও আপত্তি নেই।” যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি রাজ্য সরকারের প্রধান হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তিনি সাংবিধানিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চান বলেই এখন দাবি করছেন মমতা। যদিও মাত্র ক’দিন আগেও এমন সুর ছিল না তাঁর গলায়। মমতাই দেশের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যিনি গত সাত মাসে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় পাননি। রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মোদীর মুখোমুখি বসিয়ে দিয়েছেন, তখন তাঁকে প্রবল কটাক্ষ করেছেন মমতা। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের ফাঁস সব অঙ্ক উল্টে দিয়েছে। মমতা আগের বার দিল্লি এসে দেখা করেছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলির সঙ্গে। মোদী অবশ্য তখন দেশে ছিলেন না। এ বার সেই মোদীর মুখোমুখি হলেন মমতা।

কিন্তু মমতার বাড়ানোর এই শ্বেত পতাকার কোনও প্রভাব সারদা তদন্তে পড়বে কি? বিজেপি শিবির স্পষ্টই জানাচ্ছে, তার কোনও সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজে সিবিআই প্রধানকে বলে দিয়েছেন নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করতে। আশ্বাস দিয়েছেন, কোনও রাজনৈতিক চাপের মুখে তাঁকে পড়তে হবে না। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানাচ্ছেন, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাজ্যগুলির সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক রক্ষা করার কথা গোড়ার দিন থেকেই বলে আসছেন মোদী। মমতার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হবে না। কিন্তু তার সঙ্গে সারদা তদন্তকে লঘু করার কোনও সম্পর্ক নেই।

রাজ্যের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় অবশ্য এ দিন বলেন, “এটা নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎকার। তার বেশি কিছু নয়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখরোচক জল্পনা হতে পারে। কিন্তু তার কোনও সারবত্তা নেই।” সারদা মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান অবশ্য বিশ্বাস করেন, বাঁচার মরিয়া চেষ্টা থেকেই সুর পাল্টে প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “অন্য কেউ হলে বলতাম এটা স্বাভাবিক সৌজন্য সাক্ষাৎ। কিন্তু মমতা বলেই বলছি, এটা অস্বাভাবিক। উনি খড়কুটো ধরে বাঁচবার চেষ্টা করছেন। মোদীর হাতে-পায়ে ধরে রক্ষা পেতে চাইছেন।”

শুধু মোদীর সঙ্গে দেখা করা নয়, আরও অনেক দিক দিয়েই নরম হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন মমতা। আজই পণ্য পরিষেবা কর নিয়ে সুর কিছুটা পাল্টে কেন্দ্রকে সহযোগিতার বার্তা দিয়েছেন মমতা। দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী এবং অরুণ জেটলি এ মাসের শেষে এবং আগামী মাসের গোড়ায় কলকাতায় গেলে তাঁদের সঙ্গে বৈঠকও করবেন।

তৃণমূল এবং বিজেপি শিবিরের অনেক নেতারা আবার বলছেন, মোদীর পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বার্তা দেওয়ার দায় রয়েছে মমতার। তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তিতে বাধা দেওয়ায় মমতার প্রতি বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। সারাদ ও খাগড়াগড় কাণ্ড সেই মনোভাবকে আরও উস্কে দিয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জামাতকে নাশকতামূলক কাজকর্মের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মাটি ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তৃণমূলের অনেক নেতা। সারদার টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে জামাতের জঙ্গি কাজে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে। এহেন পরিস্থিতিতে কয়েক দিন আগেই সুর পাল্টে স্থলসীমান্ত চুক্তির পক্ষে সায় দিয়েছেন মমতা। আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে হাজির থেকে সেতু মেরামতের চেষ্টা চালালেন।

এ দিন, প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্র এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন মমতার সঙ্গে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলের সদস্যরাও এসে একে একে কথা বলে যান। মমতার সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের সংসদীয় দলের নেতা মুকুল রায়, সাংসদ মুমতাজ সঙ্ঘমিতা-সহ আরও কয়েক জন সাংসদ।

ব্যাঙ্কোয়েটের লম্বা টেবিলে সুষমার পাশেই বসেছিলেন মমতা। তাঁর প্রায় উল্টো দিকের চেয়ারে বসেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আজই হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। ফলে তিনি বেশি ক্ষণ থাকেননি। প্রণববাবু চলে যাওয়ার পর উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিই তাঁর হয়ে নৈশভোজ পরিচালনা করেন। মমতা আগাগোড়া উপস্থিত থাকলেও মূলত ফলের রস ছাড়া বিশেষ কিছু খাননি। যদিও আয়োজনে ছিল বিবিধ বাঙালি পদ। আলুপোস্ত থেকে সর্ষে ইলিশ উপভোগ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবার।



মন্তব্য চালু নেই