দায়িত্বশীল পুলিশ ও নয়ন বাছারদের স্বপ্ন

নয়ন বাছার (২৩) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা নেই। পরিবারের একবারের সন্তান। নয়ন মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায় তার বাবা তার মাকে রেখে চলে যান। নয়নই তার মায়ের স্বপ্ন। বেঁচে থাকার স্বার্থকতা। তিলে তিলে তাকে বড় করে তোলেন শিখা রাণী। জীবনের সব কষ্ট আর যন্ত্রণাগুলো ঘুচানোর স্বপ্নে বিভোর থাকতেন শিখা রাণী। কোনো নিঃসন্তান নারী বুঝবে না তার এই করুণ আকুতি। যে শিখারাণী তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে শুধু ভাগ্য পরিবর্তনের দিন গুনতেন তার সে স্বপ্ন আজ বড় বোঝায় পরিণত হলো।

নয়ন বাছার-এর বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে। এসএসসি ও এইচএসসিতে এ প্লাস রেজাল্ট ছিল নয়নের। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার এক বুক আশা নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকাতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর গর্বিত ছাত্র হন। লেখাপড়া শেষে মায়ের চক্ষু শীতল করবেন। জীবনের কষ্টগুলো লাঘব হবে। কিন্তু আজকে তার কষ্টের পরিধি যেন হিসাববিহীন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি তারা কখনো বুঝবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে কী লাগে! অথচ আজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার পরিবর্তে পুলিশের হাতে আহত-নিহতের ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাতে বাস থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নামতেই নয়নকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। নয়ন নিজেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিচয় দিয়ে বলেন ‘আমি হিন্দু, শিবির নই’। তবুও নিস্তার পায়নি নয়ন বাছার। হাঁটুর ওপরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। তার ঠিকানা এখন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল। এই হলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্ত্রাস দমনের ফিরিস্তি। পুলিশের গুলিতে আহত নয়ন আদৌ কী আর স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে চলাফেরা করতে পারবে? তার সেই উদ্যমতা ও স্বপ্নোচ্ছল চোখ কী স্বপ্নের ভেলায় ভাসবে? বরং আতঙ্ক আর হতাশা হয়তো নয়নের আগামী দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে ভর করবে। আইনের উর্ধ্বে নয় পুলিশ (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ০৭নভেম্বর, ২০১৪)

১৭ অক্টোবর ২০১৪ বাদজুমা মোহাম্মাদপুরের ইকবাল রোডে পুলিশের গুলিতে আহত হন নাফিজ সালাম (৩২) ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে তাকে দেখতে যান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেন, একজন নাগরিককে খুব কাছ থেকে এভাবে গুলি করা এক ধরনের বর্বরতা,অসভ্যতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচারণের মধ্যে পড়ে। একজন নাগরিককে পুলিশ এভাবে গুলি করতে পারে না। সেখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে পুলিশ তাকে গুলি করবে। পুলিশের বর্বর আচারণ আইনের উর্ধ্বে নয়। এভাবে গুলি করার নির্দেশ পুলিশকে কে দিয়েছে? গ্রাম অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে-সারাজীবন চকিদারি করলে কিন্তু থানার বারান্দা চিনলে না? যে পুলিশ সদস্যরা নয়ন বাছারকে গুলি করে পঙ্গু করে দিল তারা কী একবার ও তাকে অপরাধী হিসেবে যাচাই করেছিল? তার কাছে অপরাধীর কোনো আলামত পেয়েছিল? তার কাছে কিছু পায়নি। সে নিজেকে হিন্দু পরিচয় দিলেও রেহাই মেলেনি। বরং শিবির সন্দেহে তার উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। সারাজীবন পুলিশের চাকুরি করে অপরাধীর চোখ মুখ দেখে যদি না চেনা যায় তাহলে চাকরিজীবনের স্বার্থকতা কোথায়? এ যেন মশা মারতে কামান লাগানোর গল্পের মতোই হলো। একজন নিরাপরাধ মানুষকে তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার উপর রাষ্ট্রীয় পাশবিকতা কায়েম করা হলো। যেটা কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মানে কী জনগণের কাছে একটি জম কিংবা আতঙ্কের নাম হবে?

প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম, খুন অপহরণ, নির্যাতন চলছেই……….। এই উদ্দেশ্য কী ছিল তাদের সৃষ্টি ইতিহাসে। সন্ত্রাস দমন একটা রাষ্ট্রীয় সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তবে পেশাগত কর্তব্য পালনের নাম কী যত্রতত্র নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি? সন্ত্রাস দমনে সরকারের ভূমিকাকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে স্যালুট জানাতে হয়। কিন্তু নাগরিকদের রক্ষক পরিচয়ে যখন কেউ ভক্ষক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন কী আর মুখ বুজে বসে থাকা যায়? চলছে লড়াই চলবে। কেন? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তালিম। সব দায়ভার সরকার নিজের ঘাড়ে নিয়েছে তাহলে আর সমস্যা কোথায়? চলবে অ্যাকশন। কার বিরুদ্ধে? এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে। তাই কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবদার পালনে আমাদের পুলিশ সদস্যরা মানুষ হত্যার লাইসেন্স নিয়ে স্বপ্নের আকাশে বেলুন ফাটাচ্ছে?

বাড়ছে বেতন। সুযোগ সুবিধাও মিলছে ঢের। শুধু সরকারের পায়েরবি। তাই স্বার্থসিদ্ধির এই সুযোগকে হাতছাড়া করা যায়?

সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যের বক্তব্য-র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ গত ২৫ জানুয়ারি খুলনা র‌্যাব -৬ পরিদর্শনকালে এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন- বাংলাদেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই। এটি সস্তা চমকপ্রদ কথা। পুলিশের কাছে যে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তা নিছক হা ডু ডু খেলার জন্য নয়।

৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর পুলিশ লাইনে জেলা পুলিশ আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন-শুধু গুলি করা নয়, নাশকতাকারীদের বংশধর পর্যন্ত ধ্বংস করে দিতে হবে। আমি হুকুম দিয়ে গেলাম সব দায় দায়িত্ব আমার।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন- রাজাকারের উত্তরসুরিদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তাদের পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। একটি লাশ পড়লে দুটি লাশ ফেলে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে। ওই সভায় র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন- ৭১ এর পরাজিত শকুনরা আমাদের মাতৃভূমি ও পতাকাকে খামছে ধরেছে। তাদের উৎপাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এসব শকুন সন্ত্রাসী জঙ্গীদের পবিত্র ভূমিতে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান অন্য এক সভায় বলেন- পেট্টলবোমা হামলায় জড়িতদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। এছাড়া আরো অনেকে বিরোধীজোটের নেতাকর্মীদের নাশকতা দমনে বেশ তৎপরতা দেখিয়েছেন। তবে সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে বারবার পুলিশ সদস্যদের প্রতি বলা হচ্ছে বিরোধী শিবিরকে কাবু করার নামে নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে কী আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাদের কৃতিত্ব খুঁজে পাচ্ছেন? তারা জামায়াত-বিএনপি নাকি গোটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে?

আমাদের অনেকের বাবা,ভাই কিংবা অন্য কোন স্বজন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীতে কর্মরত। সবারই মুখস্ত একটি স্লোগান ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু।’ কিন্তু যখন নয়ন বাছারদের মতো নিরীহ মেধাবী মুখ গুলোর হাসি পুলিশ সদস্যের বন্দুকের নল কেড়ে নিচ্ছে তখন বলুন তো …. স্লোগানটিকে কীভাবে মূলায়ন করবেন? যখন দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কোন একটি পক্ষের হয়ে কাজ করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি,অ্যাসাইনমেন্ট ফলো করে, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকে তখন তাদের কাছে সেবার প্রত্যাশা অরণ্যে রোদন মাত্র। আর এই প্রবণতার কারণে আজকের বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ, দুর্দশা। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত এ এস এম সামছুল আরেফিন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা’ শীর্ষক স্মারকটি প্রতিটি পুলিশ সদস্যের পড়া উচিত। তাহলে খুব সহজে দেশপ্রেমের পাঠ নিতে পারবেন। হৃদয়ে তৈরি হবে সেবার মানসিকতাও। আর যদি পুলিশের চলমান আচারণ চলতে থাকে তাহলে সময়ের পরিবর্তনে তাদের সে গৌরব ইতিহাস মুছে যাবে। হয়তোবা নতুন কোনো খেতাবের মুকুটে ভূষিত হবেন। যাহোক কেউ মোমবাতিতে কিংবা পেট্টলবোমায় পুড়লে বার্ণ ইউনিটে চলে যান আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান,আরো অনেকে…………। তারা নিজেরা কাঁদেন, আমাদেরকেও কাঁদান। কিন্তু যখন নয়ন বাছাররা পুলিশের গুলিতে নির্মম ভাবে আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাতে থাকে তখন তো তাদের পাশে কেউ তো দাঁড়ান না। আর দাঁড়িয়ে বা লাভ কী? হ্যাঁ, লাভ তো আছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ফটো সেশনের মহড়া………….।

প্লিজ বের হয়ে আসুন রাজনীতির এই অন্ধগলি থেকে। শুধু দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসুন আগামীর একটি সোনালী ইতিহাস তৈরির জন্যও।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই