তাহের হত্যায় নেতৃত্ব দেয় গাড়িচালক নাসির ও গৃহকর্মী নূরজাহান

সায় লুট করার জন্যই রাজধানীর রামপুরায় অবসরপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তা আবু তাহেরকে হত্যা করা হয়। ডাকাতি ও লুটের ঘটনায় ছিল ১০ জনের একটি দল। এই দলের নেতৃত্ব দেয় তাহেরের গাড়িচালক নাছির। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্বৃত্তদের বাসায় নিয়ে পুরো হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করে তাহেরের বাসার গৃহকর্মী নূরজাহান।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামির আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গত ১ মার্চ দিবাগত রাতে রামপুরা টিভি রোডের নিজ বাসায় খুন হন অবসরপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তা আবু তাহের। এ ঘটনার তদন্তে নেমে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে চারজনই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

সর্বশেষ গত শনিবার অন্যতম আসামি আমির হোসেন (২২) তার জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের পর এর সঙ্গে জড়িত অপর পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার ইকবাল হোছাইন বলেন, ‘চার জনের ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে হত্যার রহস্য বেরিয়ে এসেছে। পরে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মালিকের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে গাড়িচালক নাছির তার সহযোগীদের নিয়ে ডাকাতি ও তাহেরকে হত্যা করে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১০ জনের নাম জানা গেছে যাদের মধ্যে পাঁচ জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সূত্র জানায়, গত শনিবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আমির অকপটে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী নাসির। বাড়িতে ঢুকে হত্যা ও লুট করতে সহায়তা করে গৃহকর্মী নূরজাহান। এই হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র ছয় হাজার টাকা ও সামান্য কিছু সোনার অলঙ্কার ভাগে পায় আমির।

জানা গেছে, পিরোজপুরের কালীকাঠির মতিউর রহমানের ছেলে আমির রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ২৫/১/ক ছালাম মজুমদারের বাড়িতে থাকতেন। আমিরকে তার বাবাই পুলিশে ধরিয়ে দেয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি জানান, প্রায় এক বছর আগে মেরাদিয়া সিপাহীবাগ বাজারে নাছিরের শ্বশুর সেলিমের চায়ের দোকানে পরিচয় হয় তাদের। মেরাদিয়া মধ্যপাড়া হালিমের রিকশার গ্যারেজে নাছির, রুস্তম, রাসেল, সোহেল, নুর আলম, মাসুদ, সুজনসহ আরো কয়েকজন এক সঙ্গে জুয়া খেলতেন। এভাবে নাছিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

গত ১ মার্চ সন্ধ্যায় নাছির, রস্তম, রাসেল, সোহেল, নুর আলম, মাসুদ, সুজনসহ তারা ২০/২৫ জন হালিমের গ্যারেজে তাস খেলছিল। নাছির খেলায় হেরে যায়। পরে নাছির সবাইকে বলে- ‘আমার স্যারের বাসায় রেড দেবো (ডাকাতি করব)’। আমির প্রথমে রাজি না হলেও স্যারের বাসায় অনেক টাকা আছে শুনে রাজি হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমির, রুস্তম, রাসেল, সোহেল, নুর আলম, মাসুদ, সুজনসহ আট জনকে নাছির তার স্যারের বাসা চিনিয়ে দেয়। এরপর হাতিরঝিলে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা হয়। রাত ১ টার দিকে ১/২ জন করে আবু তাহেরের টিভি রোডের বাড়ির সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। ওই সময় তাদের কাছে একটি ব্যাগে তিনটি ছোরা ছিল, অন্য একটি ব্যাগে একটি হাতুড়ি, একটি সেলাই রেঞ্জ ও কিছু লাল কালো কাপড় ছিলো।

আমির জবানবন্দিতে জানান, তারা সীমানা প্রাচীর টপকে বাড়ির বাগানে প্রবেশ করে। নাছির বাগানে বসে কাজের মেয়ে নুরজাহানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। কিছুক্ষণ পর নাছির তার কাছে থাকা চাবি নিয়ে কলাপসিবল গেট খুলে সবাই ভবনের দোতলায় উঠে। নাছির তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে আবু তাহেরের দোতলার ফ্ল্যাটের প্রধান দরজা খোলার চেষ্টা করে। খুলতে না পেরে সবাই নিচে বাগানে নেমে আসে। নাছির আবার ফোনে নূরজাহানকে জানালা খুলে দিতে বলে। কাজের মেয়ে বাড়ির পেছনের দিকের জানালা খুলে দেয়। তখন বাগানে এসে তারা ভবনের চার পাশ ভাল করে দেখে নেয়। কিছুক্ষণ পর তারা ভবনের পেছন দিকে গিয়ে দেখে দোতলার জানালা খোলা। তখন আমির, নাছির ও রস্তম সেলাই রেঞ্জ ও হাতুড়ি নিয়ে সানসেট বেয়ে উঠে দোতলার জানালার কাছে যায়। তারা সেলাই রেঞ্জ ও হাতুড়ির সাহায্যে জানালার গ্রিল ভেঙ্গে ফেলে। এরপর একে একে সবাই দোতলার ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমির, নাছির ও রাসেল হাতে ছিল ছুরি।

আমির জানায়, এ সময় কাজের মেয়ে নুরজাহান আবু তাহেরের শোবার ঘরের দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে তাহেরের স্ত্রী ডাক দিয়ে বলে, কে, নুরজাহান? নুরজাহান উত্তর দেয়- হুঁ। তখন দরজা খুলে দেন তাহেরের বৃদ্ধা স্ত্রী। এ সুযোগে আমির, নাছির, রস্তম ও সোহেল ঢুকে পড়ে। তারা তাহেরের স্ত্রীকে জিম্মি করে তার হাত, পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। নাছির, রাসেল ও সোহেল বিছানায় ঘুমন্ত আবু তাহেরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এসময় তার স্ত্রীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে দুটি আলমিরা খুলে টাকা পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নিয়ে একটি চাদরে দিয়ে পোটলা বাঁধে। তখন নাছির বলে, ‘স্যার (তাহের) জেগে উঠলে চিৎকার করতে পারে, তোরা একটু পোছ দিয়ে আয়।’ আমির স্বীকারোক্তিতে বলে, ‘একথা শুনে আমি স্যারের হাটুর উপরে কেটে দেই। সোহেল হাতের কনুইয়ের নিচে কেটে দেয়। এরপর আমরা বেডরুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। কাজের মেয়েদের রুমে এসে নাছির ও রাসেল তাদের সঙ্গে কথা বলে। এরপর চাবি দিয়ে দরজা খুলে আমরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাউন্ডারি ওয়াল টপকে রাস্তায় চলে আসি।’

এরপর রামপুরা টিভি রোড হয়ে বনশ্রীর বালুর মাঠ দিয়ে মেরাদিয়া চলে যায় তারা। যাওয়ার সময় ছুরির ব্যাগটা বালুর মাঠের পাশে ঝিলের কিনারে ফেলে দেয়। মেরাদিয়া পৌঁছে সকালে পোড়াবাড়ীর হোটেলে নাস্তা খায় তারা। এরপর ডাকাতির টাকাগুলো ভাগ করে। স্বর্ণালঙ্কারগুলো নুর আলমের কাছে জমা রেখে যে যার মত করে চলে যায়। একদিন পর তারা নয়জন নুর আলমের বাসা থেকে সোনার পোটলা নিয়ে আফতাব নগরে যায়। সেখানে তারা স্বর্ণালঙ্কারগুলো বাছাই করে। ইমিটেশনগুলো রামপুরা খালে ফেলে দেয়। বাছাই করার পর একটি সোনার চুড়ি, একটি সোনার আংটি ও দুটি সোনার বোতাম পায় তারা। আমির হোসেন আদালতকে বলেন, ‘তিনি ও রুস্তম বিক্রি করার জন্য সোনার গহনাগুলো নিয়ে মেরাদিয়া মেইন রোডের একা জুয়েলার্সের মালিক সুমনের কাছে যায়। সুমন তাকে ৬২ হাজার টাকা দেয়। এরপর টাকাগুলো তারা ভাগ করে ফেলে। নাছির একা পায় ২০ হাজার টাকা। অন্যরা ছয় হাজার টাকা করে পায়। পরদিনই আমির পালিয়ে কুমিল্লা চলে যায়। পরে বাসায় ফিরলে বাবা আমিরকে ডিবি অফিসে নিয়ে এসে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। এরপর পুলিশ তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে সুমনের একা জুয়েলার্সের দোকান থেকে বিক্রি করা স্বর্ণগুলো গলিত অবস্থায় উদ্ধার করে।



মন্তব্য চালু নেই