তনু হত্যা: সিআইডির তালিকায় সেনাসহ ২২

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়েছে। আর তার লাশটি জঙ্গলে এনে ফেলা হয়েছে। ডিএনএ রিপোর্টে ৩ জনের রক্ত পাওয়া গেছে। ফলে ৩ সেনা সদস্যসহ ২২ জনের সন্দেজনক তালিকা করেছে সিআইডি। অন্যদিকে স্পর্শকাতর এ ঘটনায় চিকিৎসক ডা. শারমিন সুলতানা শাম্মী ও লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরিকারী পুলিশের এসআই সাইফুল ইসলাম কার ইশারায় প্রথম ময়নতদন্ত রিপোর্টে ধর্ষণ উল্লেখ করা করেননি তাও খতিয়ে দেখছেন সিআইডি।

তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে তনুর ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল চিকিৎসকদের কাছে হস্তান্তর করা হবে না বলে বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সিআইডি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই সূত্র জানায়, নিহত কলেজছাত্রী তনুর খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে সার্জেন্ট জাহিদ, ষষ্ঠ বীরের সিপাহি জাহিদ এবং সার্জেন্ট জাহিদসহ ২২ জন সন্দেহভাজন আসামির তালিকা তৈরি করেছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। এ তালিকা এখন সিআইডির হাতে রয়েছে।

তনুর পরিবারের দেয়া নামও জড়িত থাকতে পারে এমন ব্যক্তিদের নাম তাতে রয়েছে। যে কোনো সময় তাদের ডিএনএ টেস্টের ডাক পড়বে। সিআইডি সূত্র জানায়, তনুর মরদেহ, কাপড় ও তার অন্তর্বাস থেকে নেয়া আলামতে পাওয়া তিন ধর্ষকের বীর্য সংবলিত ডিএনএ রিপোর্ট কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (কুমেক) ফরেনসিক বিভাগের নিকট হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সিআইডি।

সূত্র জানায়, তনুর শরীরের পোশাকে ডিএনএ পরীক্ষায় তিন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া যায়। এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়, হত্যাকাণ্ডের আগে তনু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ওই ২২ ব্যক্তির ডিএনএ টেস্ট হলেই কোনো না কোনো ব্যক্তির তনুর ডিএনএ নমুনার সঙ্গে খুনিদের কারোটা মিলতে পারে। তাহলে সহসাই তনু খুনি ও ধর্ষকরা শনাক্ত হবে।

এয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, তনু মরদেহ ২১ মার্চ সকাল ১১ টায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেয়া হয়। সে লাশ ফেরত দেয়া হয় বিকাল সাড়ে ৪টায়। এতো দেরি করে তারা কি করছিল। ময়নাতদন্তের সময় চিকিৎসকের মোবাইলে কাদের ফোন এসেছে তা খতিয়ে দেখার দাবি জানাচ্ছি। তারা আরো জানান, কুমিল্লা সেনানিবাসের ১২ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের সার্জেন্ট জাহিদ, ষষ্ঠ বীরের সিপাহি জাহিদ এবং সার্জেন্ট জাহিদের বাসার সামনের বাসার সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। সাজেন্ট জাহিদের স্ত্রী ও বড় মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। তারা অনেক কিছু জানে।

অপরদিকে কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনায় প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. শারমিন সুলতানা শাম্মীর দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ওই ময়নাতদন্তে কেন ও কী কারণে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর নেপথ্যে বিশেষ কোনো মহলের চাপ, আর্থিক প্রলোভন কিংবা দায়িত্বে অবহেলার বিষয় ছিল কি-না তাও খুঁজে বের করতে তদন্ত করছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। তাছাড়া দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে এত সময় নিলেও প্রথম ময়নাতদন্ত কেন এত তাড়াহুড়ো করা হয়েছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের বিচারের দাবি তুলেছেন কুমিল্লার মানবাধিকার কর্মীরা। তাই যে কোনো দিন ওই চিকিৎসককে ডেকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তনু হত্যার পর তার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন করেছিলেন কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার অধীন ক্যান্টনমেন্ট ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. সাইফুল ইসলাম। লাশের প্রকৃত চিত্র তার প্রতিবেদনের এসেছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে পুলিশের ওই এসআইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। বর্তমানে এসআই সাইফুল ওই ফাঁড়ির দায়িত্বে নেই বলে জানা গেছে।

চাঞ্চল্যকর তনু হত্যা মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে সিআইডি ঢাকার বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আখন্দ বলেন, ময়নাতদন্তে কিংবা সুরতহালে কোনো আলামত লুকানো সিআরপিসি অনুযায়ী অপরাধ। প্রয়োজনে আবারো প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও লাশের সুরতহাল করা এসআইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অভিজ্ঞ এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, স্পর্শকাতর এ মামলার তদন্তে সব বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে তনু হত্যা মামলার তদন্ত চলছে।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ ও দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা বলেছেন, সিআইডি আদালতের মাধ্যমে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ডিএনএ রিপোর্ট নিতে বলেছে। আমরা পরবর্তী কার্য দিবসে সভা করে সিদ্ধান্ত নেব। ডা. সাহা জানান, যেহেতু ডিএনএ রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে, তাই ডিএনএ রিপোর্ট সহায়ক হিসেবে নিয়ে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিতে চেয়েছিলাম।

অপরদিকে কলেজছাত্রী তনু হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ২৫ মার্চ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় ডিবির কাছে। কিন্তু খুনিরা শনাক্ত ও গ্রেফতার না হওয়ায় থানা পুলিশ ও ডিবির হাত ঘুরে ২৯ মার্চ দেশজুড়ে আলোচিত এ মামলার তদন্তভার দেয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এরপর থেকে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।

এদিকে ডিএনএ রিপোর্টে তিন ধর্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে তনুর পরিবার। মঙ্গলবার তনুর মা আনোয়ারা বেগম, বাবা ইয়ার হোসেন ও ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল বলেন, প্রথম ময়নাতদন্তে ধর্ষণ ও হত্যার কোনো আলামতই মেলেনি- ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের এসব কথা শুনে আমরা অনেকটা শংকিত ছিলাম। কিন্তু সোমবার জানতে পারলাম ডিএনএ প্রতিবেদনে অপরাধীদের অস্তিত্ব মিলেছে। এখন আমরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে নতুন করে আশাবাদী হয়েছি।

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়েকে পরিকল্পিত ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তারা (ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক) হত্যার কোনো আলামত নেই বলে একটা রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অযৌক্তিক। শিগগির দ্বিতীয় সঠিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রায় দু’মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঘাতক শনাক্ত হয়নি। যে বা যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের বিচার ও শাস্তি চাই। আনোয়ারা বেগম আরও বলেন, ‘আমার ভেতরের কষ্টটা কাউকে দেখাতে পারছি না, কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সোমবার সারা রাত পরিবারের কোনো সদস্যই ঘুমাতে পারিনি।’

উল্লেখ্য, ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নিজের বাড়ির কয়েকশ’ গজের মধ্যে পাওয়া যায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুকে হত্যার পর কুমিল্লা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে পাওয়ার হাউস এলাকার পাশের একটি জঙ্গলে লাশ ফেলে দেয় ঘাতকরা। পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবির পর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

পরের দিন ময়নাতদন্তের পর তনুকে তার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুরে দাফন করা হয়। এক পর্যায়ে প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে চিকিৎসকরা দাবি করেন, ধর্ষিত হননি তনু। তার মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণও ময়নাতদন্তে মেলেনি। এ নিয়ে স্বজনসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা দেখা দিলে পুলিশের চাহিদায় তনুর লাশের দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।



মন্তব্য চালু নেই