ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কিছু অজানা তথ্য
মুসলিমদের মসজিদ, হিন্দুদের মন্দির আর খ্রিস্টানদের গির্জা। আমরা যেখানেই যাই না কেনো সব যায়গাতে ধর্মের চর্চা করা হয় যেনো মাসষিক ও আত্মিক উন্নতি হয়। আমি একজন হিন্দু পরিবারের মেয়ে তাই আমি হিন্দু ধর্মের নিয়ম মেনে চলি ও এ পথেই মরতে চাই। আমি হিন্দু হলেও ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অনেক কিছুই এতোদিন জানতাম না। আজকের যুগে যেখানে জানা টা অনেক সহজ।
তাই এদিক সেদিক থেকে কিছু তথ্য পেয়েছি আর সকলের সাথে ব্যাপারটা ভাগাভাগি করতে লোভ সামলাতে পারছিনা।
ঢাকেশ্বরী মন্দির ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। সলিমুল্লাহ হল থেকে আনুমানিক ১.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঢাকেশ্বরী রোডের উত্তর পার্শ্বে একটি অনুচ্চ আবেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যে মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দির অঙ্গনে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি সিংহদ্বার। সিংহদ্বারটি নহবতখানা তোরণ নামে অভিহিত। ঢাকেশ্বরী মন্দির জনশ্রুতি অনুযায়ী মন্দিরটির নির্মাতা বল্লাল সেন নামে একজন রাজা। তবে এ বল্লাল সেন প্রকৃত অর্থেই সেন বংশের বিখ্যাত রাজা কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে।
কেউ কেউ দাবি করেন যে, এখানে প্রতিষ্ঠিত ঢাকেশ্বরী মূর্তি ও মন্দির মহারাজা বল্লাল সেনের আমলের। কিন্তু স্থাপত্য নির্মাণ কৌশলের বিবেচনায় এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে তথা সেন রাজবংশের রাজত্বকালে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে মর্টার হিসেবে চুন-বালি মিশ্রণের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি আগাগোড়াই চুন-বালির গাঁথুনিতে নির্মিত, যা বাংলার মুসলিম আমলেরই স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য। আবার আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-‘আকবরী র ’দশটি সুবাহর জরিপ’ শীর্ষক অধ্যায়ে প্রতিটি সুবাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের বিশদ বিবরণ দিলেও বাংলা সুবাহর এ বিখ্যাত মন্দির সম্বন্ধে কিছুই উল্লেখ করেন নি। যদি এ মন্দির গ্রন্থটি রচনার আগে বা রচনার সময়েও নির্মিত হয়ে থাকে তাহলে ওই গ্রন্থে । এ মন্দিরের উল্লেখ থাকাটা স্বাভাবিক ছিল অন্যদিকে মন্দিরের তিন গম্বুজবিশিষ্ট ছাদ, খিলান সমন্বিত তিনটি প্রবেশপথ এবং প্লাস্টার করা দেওয়াল একটি জোরালো বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে, বাংলার মুগল স্থাপত্য রীতিতেই এ মন্দির নির্মিত। নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও মন্দিরের মূর্তিটিকে অত প্রাচীন বলে মনে করেননি।
অন্যদিকে মন্দিরের রীতি এবং গঠনকাঠামো এর নির্মাতা হিসেবে অন্য একজনকে ইঙ্গিত করে যার চরিত্রে বাংলার প্রচলিত সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। এখানে আরাকানি বৌদ্ধ মন্দিরের মতো পুকুর, অশ্বত্থবৃক্ষ, বাগান, মঠ, পান্থশালা, সন্ন্যাসীর আশ্রম, মন্ডপ, বারান্দা, গর্ভগৃহ ইত্যাদি রয়েছে। সেই সাথে আরাকানি ধর্মের মতো বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সার্বজনীনতা প্রকাশ পায় মন্দিরে সকলের উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারে। আবার এখানে দেখা যায় যুগল মূর্তি, একটি দশভুজা দেবী (ঢাকেশ্বরী দেবী নামে পরিচিত) এবং অন্যটি চতুর্ভুজ দেবমূর্তি (বাসুদেব নামে পরিচিত), যা মগদের তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক।
অন্যদিকে মগ নাথদের সাধারণত কোনো বিশিষ্ট নাম নেই। তাদের নামকরণ হয় প্রধানত স্থান, জাতি ইত্যাদি নামের উপান্তে নাথ, ঈশ্বর, ঈশ্বরী প্রভৃতি শব্দ যুক্ত করে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দশভুজা দেবীর বিশিষ্ট কোনো নাম নেই। কোথাও তিনি রাজেশ্বরী, কোথাও তিনি দুর্গা, আবার কোথাও তিনি মহামায়া বা চন্ডী। শহরের পৃষ্ঠপোষক ঈশ্বরী হিসেবে এ দশভুজা দেবীর নাম হয়েছে ঢাকেশ্বরী (ঢাকা+ঈশ্বরী)। দেবীর এ নামকরণ থেকেও এটি ইঙ্গিত দেয় যে, এ দেবী একজন মগ দেবী। আবার স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে আরাকানি প্রভাব দেখা যায়। এসব বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত করে যে, মন্দিরটির নির্মাতা আরাকানের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা মলহন ওরফে হোসেন শাহের পুত্র এবং আরাকানরাজ শ্রীসুধর্ম রাজার ছোট ভাই মঙ্গত রায় যিনি বল্লাল সেন নামে ইতিহাসে পরিচিত। আরকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বল্লাল সেন ঢাকায় আশ্রয়প্রার্থী হন। অবশ্য মন্দিরটির নামকরণের আরও একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। দেবী মূর্তিটি মাটিতে ঢাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, তাই এর নামকরণ এরূপ হয়েছে। কিংবদন্তি রয়েছে যে, সেন রাজা বল্লালসেন মূর্তিটি খুঁজে পান এবং তিনি দেবীর জন্য এ মন্দির নির্মাণ করেন।
দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রাচীনত্ব বেশ রহস্যাবৃত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্র্যাডলী বার্ট লিখেছেন যে, মন্দিরটি দুশো বছরেরও অধিক পুরানো এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন হিন্দু এজেন্ট এটি নির্মাণ করেছিলেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি কতিপয় মন্দির ও এর সংলগ্ন সৌধমালার সমষ্টি। একে দুটি অংশে বিভক্ত করা যায় পূর্বদিকস্থ অন্তর্বাটি ও পশ্চিমদিকস্থ বহির্বাটি। অন্তর্বাটিতে রয়েছে প্রধান মন্দির ও মন্দিরের সম্মুখস্থ নাট মন্দির ও অন্যান্য ইমারত। বহির্বাটিতে আছে কয়েকটি মন্দির, একটি পান্থশালা ও বেশ কয়েকটি বহিঃকক্ষ। পশ্চিমে রয়েছে উত্তর-দক্ষিণে লম্বমান একটি প্রাচীন দিঘি যার চারদিকে একটি পায়ে চলা পথ বিরাজমান। দিঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আছে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। এ দিঘি ও বিশ্রামাগারের পূর্ব পার্শ্বে সাধুদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কয়েকটি সমাধি রয়েছে।
দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর এক সারিতে সমআয়তনের একই রকমের পরপর চারটি ছোট মন্দির রয়েছে। বেশ উঁচু ভিত্তিবেদির উপর অবস্থিত বলে প্রবেশের জন্য রয়েছে সিঁড়ি। পূর্বদিকস্থ মন্দিরের সিঁড়িটি মার্বেল পাথরে নির্মিত। এ চারটি মন্দির একই উঁচু বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এরা এক একটি স্বাধীন সত্ত্বাবিশিষ্ট মন্দির। সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান লম্বা সূক্ষ্মাগ্র চূড়া বিশিষ্ট এ মন্দিরগুলি একই রীতিতে নির্মিত বর্গাকার কক্ষ বিশেষ। মন্দির চারটি যথেষ্ট উঁচু হলেও এগুলি প্রস্থে সংকীর্ণ। প্রতিটির গর্ভগৃহের ছাদ ক্রমহ্রাসমান পিরামিডাকৃতিতে উপর্যুপরি ৬টি স্তরের সমষ্টি। প্রতিটির শীর্ষদেশে পদ্মপাপড়ির উপর কলস চূড়া রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরে উত্তর দিক ছাড়া অন্য তিনদিকে খিলানের সাহায্যে নির্মিত সরু প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের উপরাংশ অনুভূমিক রেখার স্ফীত অলংকরণ দিয়ে সজ্জিত। এ অলংকরণ ও গম্বুজবিশিষ্ট ছাদের মধ্যখানে সমবৃত্তাকার খাঁজকাটা খিলানবিশিষ্ট প্যানেল রয়েছে।
এ মন্দির চারটির প্রতিটির মধ্যে রয়েছে একটি করে শিবলিঙ্গ।ঢাকেশ্বরী মন্দির কমপ্লেক্সের পূর্বদিকস্থ অন্তর্বাটিতে প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। একটি প্রাচীর দিয়ে একে বহির্বাটি থেকে আলাদা করা হয়েছে। এখানে আছে আরেকটি জমকালো তোরণদ্বার। এ সিংহতোরণের সাহায্যে অন্তর্বাটিতে প্রবেশ করতে হয়। তোরণদ্বারের উপরে আছে একটি ঝুলন্ত ঘণ্টা।অন্তর্বাটির অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মার্বেল পাথর আচ্ছাদিত দীর্ঘাসন রয়েছে, পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য আদান-প্রদানের জন্য নির্মিত। মূল মন্দিরের সামনে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে আছে নাট মন্দির। নাটমন্দিরের মধ্যে আছে পাঁঠা বলির স্থান। নাট মন্দিরের ঠিক দক্ষিণে যজ্ঞমন্দির। যজ্ঞমন্দিরে একটি যজ্ঞকুন্ড রয়েছে।
সবশেষে বলবো, আমি কটোটুকুন যেনেছি? জানিনা। তবে সামান্য জেনেছি। আর সকলকে জানাতে পেড়ে আমি কৃতজ্ঞ। যদি প্রয়াস পাই সামনে আরে রিকতে চেস্টা করবো।
-ডালিয়া রানী
ইডেন কলেজ, ঢাকা
মন্তব্য চালু নেই