ঝিলের ওপর নির্মিত বাড়িটি ছিল মরণ ফাঁদ

রামপুরা থানাধীন খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া ব্যাগের বস্তির পাশে পুরোনো ঝিলের ওপর প্রায় দেড় বছর আগে মরণ ফাঁদ তৈরি করেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের প্রকাশনা, তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির। কিছুদিন আগে ঝড়ের প্রভাবে দোতলা টিনসেড বাড়িটি নড়ে ওঠে। মনিরকে তা জানানোর পরও তিনি তা কানে নেননি। সবশেষ, গতকাল বিকেলে সেটি নিমেষেই পানির নিচে দেবে যায়। মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয় আরো ১২টি তাজা প্রাণ। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অন্তত ১২ নারী-পুরুষ।

বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে ওই বাড়িটির বাসিন্দারা সাংবাদিকদের এভাবেই অভিযোগের কথা বলেন।

ফাতেমা বেগম। চার ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে চার হাজার টাকা ভাড়ায় একটি রুম নিয়ে থাকতেন। ঘটনার সময় তার তিন ছেলে বাইরে ছিল। রাজমিস্ত্রি স্বামী বরিশালে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ফাতেমা বুকের দুধ পানকারী ছোট ছেলেকে নিয়ে ঘরের ভেতরেই ছিলেন।  তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখি পানির বুদবুদ ওপরে উঠে এলো। তখন আর কিছু না ভেবে ছেলেকে বুকে নিয়ে ওপরে থাকা লোহার রড ধরে ঝুলে পড়লাম। মুহূর্তেই আমার বুক বরাবর পানি হয়ে গেল। ছেলে ঝুলে আছে আমার গলায়; আর আমি ঝুলে আছি সেই রড ধরে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আমাকে টিন কেটে বের করে।’

ফাতেমা আরো বলেন, ‘আমার কেউ মারা যায়নি। তবে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরের ফ্রিজ, টেলিভিশন, খাট, আলমারি, সোফা, হাড়িপাতিলসহ সবকিছুই চলে গেছে। এখন শুন্য হাতে কোথায় কীভাবে থাকব? কাজ করার পর থাকব কোথায়, খাব কি? হতাহতদের তো ২০ হাজার আর ৫ হাজার করে টাকা দিয়েছে সরকার। কিন্তু যাদের সব চলে গেছে তাদের তো কিছুই দিল না!’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘যুবলীগ নেতা মনির দেড় বছর আগে এই ঘরগুলো তৈরি করেন। প্রতিটি রুম চার হাজার টাকা করে ভাড়া নিতেন। তিন/চার ইঞ্চি সিমেন্টের খুঁটির ওপর লোহার ফ্রেম বসিয়ে তার ওপর পাটাতন দিয়ে কংক্রিটের ঢালাই করা হয়। ঘরে ঢুকলে মনে হয় এটি পাকা বিল্ডিং। এ ছাড়া ঘরের বেড়া দেওয়া হয় লোহা কাঠের ফ্রেমের ওপর টিন দিয়ে। দোতলার মেঝেটিও কাঠের তৈরি আর ওপরটা টিনশেড।’

ঘটনার সময় কর্মস্থলে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান সেখানকার আরেক বাসিন্দা নাসরিন। পেশায় পোশাক-কর্মী। খবর পেয়ে ঘরে এসে দেখেন ভাইবোন দুজনই পানির নিচে। সন্ধ্যার দিকে তাদের লাশ বের করা হয়। স্বামী গ্রামের বাড়িতে থাকায় তিনিও বেঁচে গেছেন।

নিহত বোন রুনা সম্পর্কে নাসরিন বলেন, ‘রুনা হাজিপাড়া ওয়েসিস গার্মেন্সে কাজ করতো। গ্রামের বাড়ি যাবার প্রস্তুতির জন্য গতকাল সে কাজে যায়নি। বিকেলের দিকে কাপড়-চোপড় গোছ-গাছ করছিল। সে সময় সে ফোনে আমাকে বলেছিল, কাপড় গোছানো শেষ হলেই চলে যাবে। এর কিছুক্ষণ পরই খবর পাই ঘর দেবে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ভাই জাকির হোসেন সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন। বিকেলে সিএনজি রেখে বিশ্রাম নিতে ঘরে এসেছিলেন। তিনিও বের হতে পারেননি। তাদের লাশ বরিশালের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ বলেন, ‘সরকারি খাস জায়গার ওপর যারা ঘর তুলেছে, তারা যতবড় শক্তিশালী আর যে দলেরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে কোনো অবৈধ ঘরবাড়ি থাকবে না। অভিযান চালিয়ে সব ভেঙ্গে দেওয়া হবে। আর যারা ঘরসহ সবকিছু হারিয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন করা হবে। আপাতত চৌধুরীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

এর আগে, সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট শহীদুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় জমির পর্চা বের করে এর মালিককে খুঁজে বের করবে। কীভাবে পানির ওপর এই মরণ ফাঁদ তৈরি হলো, আর কারা এটা তৈরি করলেন তা-ও খুঁজে বের করবে কমিটি। আগামী ৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক এবিএম নুরুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের আরো একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নুরুল হক জানান, ঘরগুলো ছিল ১০ ফুট উচ্চতার। পানির গভীরতাও ছিল প্রায় ১০ ফুট। তাই বাড়িটির নিচতলা পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দুর্বল কাঠামোর ওপর এটি তৈরি করা ছিল। দীর্ঘদিন এ অবস্থায় থাকায় পানির নিচের দিকের খুঁটিগুলো পচে যায়। আর তাতেই পুরো বাড়িটি দেবে যায়।

নুরুল হক আরো জানান, নিচে পানি থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা বেশি হয়েছে।

বাড়িটির ম্যানেজার আরাফাত হোসেন জানান, বাড়িটি নির্মাণের কিছুদিন পর তিনি এই পদে চাকরি নেন। মাসিক ৭ হাজার টাকায় তিনি সেখানে চাকরি করতেন। স্ত্রী, মা ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেখানেই থাকতেন। ঘটনার সময় তিনি বাজারে ছিলেন। আর স্ত্রী ছিলেন কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে। তাই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে ঘরের ভেতরে থাকায় লাশ হয়েছেন মা ও একমাত্র মেয়ে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) শাকিল নেওয়াজ জানান, এখন আর কেউ নিখোঁজ আছে বলে কোনো দাবি করেনি কেউ। তারাও মনে করছেন পানির নিচে আর কেউ নেই। তারপরেও শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চালানো হবে।



মন্তব্য চালু নেই