জেনে নিন কিভাবে এল আইনের পোশাক

আদালতের বিজ্ঞ বিচারক এবং আইনজীবীদের কোট বা গাউন কালো কেন? তাদের শার্টইবা সাদা কেন? কালো টুপি পরে বিজ্ঞ বিচারক কেন অপরাধীর মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন? এসব নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে। তন্মোধ্যে স্বীকৃত বিষয়টি হলো, রোমান আইনের কার্যক্রমে কালো কোটের ব্যবহার হয়েছে, যা ইংরেজদের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের সারথি ধরে উপকথা হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।

বেঞ্চ ও বারের পোশাকের বিষয়ে বিশেষ করে কালো কোট, কালো গাউন, সাদা বো বা ব্যান্ড ইত্যাদি প্রাচীন পন্থিদের মতাদর্শের আলোকেও প্রচলিত দু’টি পদ্ধতি। এটি আইন-বিজ্ঞানে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ না থাকলেও আইনপাড়ায় বিশেষ রেওয়াজ ও আচারভিত্তিক রীতি হিসেবে প্রচলিত।

রাজা তার পোশাকবিহীন সিংহাসনে বসলে যে অবস্থা হবে, এজলাসে কালো কোট বা গাউন ছাড়া একই অবস্থার সৃষ্টি হবে। সেখানে কোনো বার ও বেঞ্চের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আসামি ও ফরিয়াদির কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে বিষয়টি প্রবহমান তা হলো, কালো কোট বা গাউন আইনপাড়ায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। এসব পোশাকে প্রতীয়মান হয় যে, আইন অন্ধ। অর্থাৎ একজন অন্ধের কাছে সবকিছুই সমান। সাদা ও কালোর কোনো ভেদাভেদ নেই। এ ছাড়া সাবুদ ও আলামতসহ (Clue) বাদী ও বিবাদী পক্ষের সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ জেরাকরণ (Crossing) এবং সর্বোপরি যে রায় দেওয়া হয়, তার বাইরে কোনো আইনজীবী ও বিচারকের যাওয়ার ক্ষমতা নেই।

এক্ষেত্রে বিশাল ক্ষমতা ও জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোনো ব্যক্তিগত মতামত প্রয়োগ বা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তাই আইনের দর্শনের আওতায় সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যেই সাদা লাঠি নিয়ে ভেবে চিন্তে এগোতে হয়। এর গুরুত্ব এত বেশি যে, (কথিত আছে) তৎকালীন কাজির এজলাসে অন্য সাধারণ প্রজার মতো স্বয়ং বাদশাহ নামদার ফরিয়াদি বা আসামি হিসেবে বিবেচিত হত। সংক্ষেপে এ কথার অর্থ হচ্ছে, আইনজীবী মামলার মেরিটের ওপর ভিত্তি করে সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তিতর্ক সংবলিত বক্তব্য রাখবেন এবং এর মধ্যে আইনের ধারা, উপধারা, বিধি, প্রবিধি, নজির ইত্যাদি টেনে আনতে পারবেন। তেমনি বিজ্ঞ বিচারকও সব দিক বিবেচনা করে অন্যদিকে না তাকিয়ে বা আইনের স্বচ্ছতার রূপ পরিগ্রহ করে অন্ধত্বের প্রেক্ষাপটে সুবিবেচক ও বস্তুনিষ্ঠ রায় দেবেন।

তবে বিকল্প তত্ত্বে মনে করা হয়, কালো কোট বা গাউনের অর্থ নিজের পরিচয় গোপন রাখা। এ ছাড়া কালো কোট বা গাউনের মধ্যে গলায় সাদা বো বা ব্যান্ড ব্যবহারের প্রধান হেতু হলো তিমিরাচ্ছন্ন থেকে সাদা তথা আসল সত্যকে খুঁজে বের করা (As the Bow & Band being the symbol of keying or searching out hidden real truth of incidence).

ইতোপূর্বে বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলোর বেঞ্চে, বিচারকদের পরিধানকৃত কালো কোট বা গাউনের হাতা তার হাতের চেয়ে লম্বা রাখার রেওয়াজ ছিল। এখন আর সে রীতির প্রচলন নেই। তবে যুক্তরাজ্যে এই বিধি এখনো মেনে চলা হচ্ছে। লম্বা হাতার ব্যাখ্যা হলো, আইনের হাত এত দীর্ঘ যে আসামি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, এ হাত তাকে খুঁজে বের করবেই। অন্যভাবে বলা হয়ে থাকে, অপরাধী যত জ্ঞান বা ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, আইনের হাত লম্বা বিধায় সংশ্লিষ্ট সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেঞ্চের রায় মানতে বাধ্য। এদিকে বিচারকের সাদা লম্বা পরচুলা পরার রেওয়াজ আমাদের দেশে উঠে গেছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এখনো পরচুলা পরে থাকেন। বিচারকের পরচুলা পরিধান ছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কোনো বিচারকাজ সম্পন্ন হয় না। তারা এখনো এর গুরুত্ব এবং নিগূঢ় দর্শন আঁকড়ে আছেন।

সাদা পরচুলার পেছনের রহস্য হলো, বৃদ্ধ মা-জননী সন্তানের প্রতি যেমন স্নেহপরায়ণ, তার কাছে সব সন্তান একই এবং সমান। কারও প্রতি অবিচার করার মানসিকতা থাকে না। সে আলোকেই দু’পক্ষই (বাদী ও বিবাদী) তার সন্তান বলে বিবেচ্য। তাই বিচার কার্যে সঠিক বিচারের পথ সমুন্নত থাকে এবং কোনো পক্ষপাতিত্বের অবকাশ থাকে না। এজলাসে দুই পক্ষের কথা ও আবেদন আন্তরিকভাবে শুনে, বিচারক ঠান্ডা মাথায় রায় দিয়ে থাকেন। যাতে বিবাদী আত্মপক্ষ সমর্থন, মৌলিক অধিকার ও ন্যায়পরায়ণতার বরখেলাপের কোনো সুযোগ না পায়।



মন্তব্য চালু নেই