জেনে নিন, কিভাবে এলো দেশের মাটিতে বিদেশের ফল!

১৯৯৬ সাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক ড. এম মঞ্জুর হোসেন জাপানে উচ্চ শিক্ষার গবেষণার সময় গবেষণাগারে স্ট্রবেরি দেখে আকৃষ্ট হন। এটি দেখতে যেমন দৃষ্টিনন্দন, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। ভাবলেন, বাংলাদেশে এমন একটি ফল থাকলেতো ভালোই হয়। সেই ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটাতে স্ট্রবেরির আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। প্রথমবার আবাদ করলেও গাছটি মরে যায়। পরে গিয়ে আবার অন্য একটি জাত নিয়ে আসেন। এবার আশার আলো জাগল। স্বপ্ন দেখা শুরু হলো তার। আর স্বপ্ন পূরণে সময় লাগলো দীর্ঘ ১২ বছর।

এই সময় ধরে ফলটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তিনি। আবাদ কৌশল বের করেন। এভাবে একে একে তিনটি জাত বের হলো। এই স্ট্রবেরি বাংলাদেশে অতি পরিচিত একটি ফল। আলাপকালে অধ্যাপক ড. এম মঞ্জুর হোসেন বলেন, আমি এক প্রকার স্ট্রবেরির প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম। আর এই প্রেম থেকেই বাংলাদেশে নিয়ে আসা।

স্ট্রবেরির মতো বাংলাদেশে যেসব বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে তার প্রতিটির পেছনে আছে এক একটি গল্প। কেউ গবেষণা করতে গিয়ে, কেউ পর্যটক হয়ে বিদেশ থেকে চারা, কাণ্ড নিয়ে এসে এ দেশে আবাদ করছেন। বিদেশি ফলগুলো মূলত থাইল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, পাকিস্তান, ব্রাজিল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কোন ধরনের গবেষণা ছাড়াই অনেকে বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করছেন, ভাল ফলনও পাচ্ছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিদেশি ফল নিয়ে গবেষণা করছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দেশিয় ফলের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি ফল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব ফল সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এগুলোর চারা উত্পাদন এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণও হচ্ছে। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০টি বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাম্বুটান, এভোকেডো, লংগান, শান্তল, জাবাটিকাবা, স্ট্রবেরি, কিউই, ডানান, এ্যানোনি, ম্যাঙ্গোস্টিন, ডুরিয়ান, আলুরখারা, এপ্রিকট, পেস্তা, মাল্টা, পার্সিমন, কেন্টালিপ, কমলা, আঙ্গুর, আপেল, এগফ্রুট, স্টার আপেল, প্যাশনফল, চেরি, নাশপাতি, ব্রেডফ্রুট, অ্যাগুলিটান, পীচ, ডুমুর, ল্যাংটান ইত্যাদি ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব ফল বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে না।

বাংলাদেশে চাষ হওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদেশি ফল স্ট্রবেরি। অক্টোরের তৃতীয় সপ্তাহে রোপণ করলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মার্চ পর্যন্ত এটি ফলন দেয়। একটি গাছ থেকে চার মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। প্রতি স্ট্রবেরির ওজন ১০ থেকে ১৫ গ্রাম।

রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, নওগাঁ, রাজশাহী, জয়পুরহাট, পাবনা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ দেশের ১৯-২০টি জেলায় এখন এই ফল চাষ করছে কৃষক ও যুবকেরা।

নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার শাল্লাবাদ ইউনিয়নে স্ট্রবেরি চাষ করে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। বিভিন্ন পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ লিচুর মতো সদৃশ। স্ট্রবেরি চাষ করতে এগিয়ে আসছে অনেক তরুণ কৃষক। এলাকার কৃষকদের মাঝে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। পাহাড়ের মাটি উপযুক্ত হওয়ায় স্ট্রবেরি চাষে সম্ভাবনা পাহাড়েই সবচেয়ে বেশি।

ড্রাগন ফলঃ এই ফলটির উত্পত্তিস্থল মধ্য আমেরিকা। ২০০৮ সালে থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে নিয়ে আসেন ড. রহিম, যিনি জার্মপ্লাজম সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। এখন হিলি অঞ্চলসহ সাতক্ষীরা, পাবনা, নীলফামারীতে ড্রাগন ফলের চাষ করা হচ্ছে।

ড্রাগন ক্যাকটাস গোত্রের একটি ফল। এ ফলের গাছ হয় লতানো। কিন্তু এর কোন পাতা নেই। ভিয়েতনামে এ ফল সর্বাধিক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।

এপ্রিল মাসে এ গাছে ফুল আসে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফল ধরে। ফলের বাইরের রং হয় লাল। তবে ভেতরের রং লাল, সাদা ও হলুদ হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য উপযোগী জাত হিসাবে জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল) অবমুক্ত করা হয়েছে।

রাম্বুটানঃ রাম্বুটান লিচু পরিবারের গ্রীষ্মকালীন ফল। ১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এ ফল। বর্তমানে নেত্রকোনা, হালুয়াঘাট এবং পাহাড়ীয়া অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে। ফলের গাছ বামন আকৃতির হয়ে থাকে তবে ফলের রং হলুদ, লাল হয়ে থাকে। ফলের উপর লোমশ অংশ আছে এবং খোসা ছাড়ালে লিচু ফলের মত আটি বের হয়।

দুই দশক আগে মালয়েশিয়া থেকে ফেরার সময় রাম্বুটান নিয়ে আসেন নেত্রকোনার উসমান গণি। সেই ফলের বীজ থেকে জন্মায় দুটি গাছ। পাঁচ বছর পর আসে ফল। পরে ধীরে ধীরে বাড়ে গাছের সংখ্যা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লিচু আকৃতির জনপ্রিয় এই ফলের বাগান নিয়ে মানুষের উত্সাহের শেষ নেই। রসালো ফলটি পছন্দ করে না এমন লোক খুব কম।

লঙ্গানঃ ১৯৯৫-৯৬ সালে লঙ্গান প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এটিও লিচু পরিবারের গ্রীষ্মকালীন ফল। গাছ বামন আকৃতির, পাতা ডিম্বাকার এবং ফলের রং খয়েরী এবং সাদা পাল্পযুক্ত হয়।

প্যাশন ফলঃ ২০০৩ সালে থাইল্যান্ড থেকে প্রথম প্যাশন ফল বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। প্যাশন ফলের গাছ লতানো হয় এবং মাচা করে দিতে হয়। এই ফলটি সারা বছর পাওয়া যায়। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের হাটভরতখালি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান সুজা ২০০৮ সালে আইভরিকোস্ট থেকে প্যাশন ফল নিয়ে আসেন। তা এনে বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন সুজা। কয়েকদিনের মধ্যে চারা গজিয়ে ওঠে। সুজা লতানো গাছ বেড়ে ওঠার জন্য মাচা বানিয়ে দেয়। এক বছরের মধ্যেই শত শত ফল আসে। আর দুই মাসের মধ্যে ফলগুলো পেকে যায়। ফলের রস সুস্বাদু হওয়ায় অনেকেই এই বীজ সংগ্রহ করে বাড়ির আঙিনায় রোপণ করে।

পার্বত্য অঞ্চলে কয়েক বছর থেকে প্যাশন ফলের চাষ হলেও দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের ভাউলাগঞ্জ বানিয়াপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহসিন আলীর বাড়িতে গত কয়েক বছর যাবত্ উত্পাদিত হচ্ছে সুস্বাদু ও মজাদার প্যাশন ফল। তারাই এখন এই ফলটির বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছেন। তাদের কাছ থেকে চারা নিয়ে অনেকেই শখের বসে প্যাশন ফলের গাছ লাগিয়েছেন।

শান্তলঃ ২০০৩ সালে পাকিস্তান থেকে এ ফলটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। লটকন পরিবারের। শান্তল গ্রীষ্মকালীন ফল হিসেবে পরিচিত।

বাউকুল: ২০০১ সালে ৫টি দেশ থেকে প্রায় ১৯টি জাতের কুল নিয়ে আসা হয়। পরে দেশে নিয়ে এসে জার্মপ্লাজম সেন্টারে পরিচর্যা করে একটি জাতকে ভাল বলে নির্বাচিত করা হয়। পরে সেই ফলটি বাউকুল হিসেবে পরিচিত লাভ করে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া চেরি পাকিস্তান থেকে, ভারত ও নেপাল থেকে নাশপতি এং জাপান থেকে পার্সিমন এদেশে নিয়ে আসা হয়। এখন জার্মপ্লাজম সেন্টারে এর চাষাবাদ চলছে। এছাড়া ৩ প্রজাতির চাইনিজ লিচু জার্মপ্লাজম সেন্টারে নিয়ে আসা হয়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান বাদল বলেন, বিদেশ থেকে দেশে আসা বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে স্ট্রবেরির একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর ড্রাগন ফ্র্রুট নামে একটি নতুন ড্রাগন ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, বাজারে চায়না কমলা পাওয়া যাচ্ছে। এই ফল সাধারণত চীন থেকে এ দেশে আনা হয়েছে। এই ফল নিয়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট ড. মো. শামছুল আলম মিঠু জানান, এদেশে বিদেশের আকর্ষণীয়, সুস্বাদু ও মূল্যবান ফল এনে এগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত।



মন্তব্য চালু নেই