জাল টাকার উৎস বন্ধ করুন

আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে বাজারে প্রচুর পরিমাণে জাল নোট ছাড়া হয়েছে। কে বা কারা এর সাথে জড়িত অনেক সময়ে তার হদিস মিলছেনা। প্রত্যেক ব্যবসায়ীদের যেমন একটি বিক্রির মৌসুম থাকে প্রতারক চক্রের ও মৌসুম রয়েছে। দু’টো ঈদ, পহেলা বৈশাখ ,নববর্ষ ও পূজা-পার্বন এলেই জাল টাকার ব্যবসয়ীরা তৎপর হযে ওঠে। এক সময়ে ছিচকে চোর শ্রেণীর লোকেরা এ ব্যবসায় থাকলেও এখন আর তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষিত একটি শ্রেণী এ পেশায় এসে এ ব্যবসাকে আরো বেশি গতিশীল করেছে।

এছাড়াও স্মার্ট তরুণ- তরুণী ও যুবক শ্রেণীর একটি অংশ জাল ব্যবসায় সক্রীয় থাকায় খুব সহজে তাদের সনাক্ত করা যায় না। এই ধরণের প্রতারকদের দেখে কখনোই মনে হবে না যে, এরা এ কাজটি করতে পারেন। এরা কখনোই একাধীক জাল নোট একই সময়ে বহন করেন না। তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে চলা ফেরা না করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বেশ ধারণ জনবহুল বিভিন্ন স্থানে তারা আড্ডা দিয়ে থাকে। আর তাদের কেউ যখন জাল টাকা চালাতে গিয়ে বিপদে পড়ে তখন তাকে উদ্ধারে অন্যরাএগিয়ে যায়।

কোনোভাবে একটি বড় নোট বাজারে ছেড়ে দিতে পারলে মুহূর্তেই তারা ওই স্থানটি ত্যাগ করে। ধরা পড়লে প্রতারকের ভাবখানা এমন থাকে যে, টাকা জাল হওয়ায় তার বড়ই ক্ষতি হয়ে গেল। বেশি কিছু বললেই হয়তো কান্ন্ করে দিবে। আবার যার কাছে জাল নোট মজুদ থাকে সে কখনোই তার গ্রুপ ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে টাকা বাজারে ছাড়ে না। এভাবে খুব সতর্কতার সাথে জাল নোটগুলো বাজারে চলে আসে। যারা এদের ফাঁদে পড়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। কখনো-বা সম্মানের হানিও ঘটে।

গত ২৮ জানুয়ারি(২০১৫) রাতে রাজধানীর বনশ্রী এলাকার ১৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে ১ কোটি চার লাখ আশি হাজার টাকার জাল নোটসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। যাদেরকে ধরা হয়েছে তাদের যদি কঠোরভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয় আর সে সংবাদটিকে গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয় তাহলে বেশি ফায়দা পাওয়া যেতে পারে। গ্রেফতার করার সংবাদটির চেয়ে তাদের শাস্তির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হলে অপরাধের মাত্রা যেমন কমে আসবে, তেমনি প্রতারকদের মাঝে ভীতির সঞ্চার হবে।

ইতোমধ্যে রাজধানীতে পর পর কয়েকটি জাল টাকা তৈরীর কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীতে ঘনবসতি এবং বাসা-বাড়ির মালিকগণ তাদের ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে যথাযথ নজরদারি না করার কারণে খুব সহজেই বাসার অভ্যন্তরে জাল টাকা তৈরীর কারখানা স্থাপন করে টাকা জাল করছে অপরাধীরা।সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে জাল টাকার কারখানার জন্য রাজধানী শহরেকেই বেশি প্রধান্য দেয়া হয়ে থাকে।

পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, ছোট বড় মোট ৫০ এর অধিক বিশ্বস্ত চক্রের মাধ্যমে সারাদেশে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু ঢাকাতেই রয়েছে ২০ থেকে ২৫ টির মত গ্রুপ। র‌্যাব কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, গত ২৭ জুন পর্যন্ত জাল টাকা চক্রের এক হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর জাল নোট চালানোর জন্য বেছে নেয়া হয় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা ও ব্যস্ততম সময় কিংবা খুচরা পর্যাযের দোকানসমূহ। মানুষেরা যখন খুব ব্যস্ত থাকে তখনই এদেরকে বেশি তৎপর হতে দেখা যায়। গোয়েন্দা তথ্য মতে, জাল টাকা তৈরীর এসব চক্রের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারিরও যোগাযোগ রয়েছে। যার ফলে ব্যাংক ও এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সময় জাল নোট পাওয়া যায়।

নিজের অজ্ঞতা বা অসতর্কতার কারনে কারো হাতে যদি জাল টাকা এসে পড়ে, সে যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে জন্য টাকাটি কোন না কোন ভাবে বাজারে ছেড়ে দিতে চেষ্টা করে। সাধারণত কোন মানুষই তার ক্ষতি মেনে নিতে চায় না। নিজের স্বার্থে সে নিজেই হয়ে ওঠে একজন প্রতারক। জাল নোট প্রস্তুতকারিসহ এর সাথে যারা জড়িত তারা হলো পেশাদার প্রতারক। আর জাল নোট হস্তগত হওয়া ভূক্তভোগী মানুষটি অপেশাদার প্রতারক। কেউ নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হোক তা সে চায় না।

কিন্তু তার অপর ভাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এটা যেন তার কাছে আনন্দের বিষয়। কোন কোন মহল্লায় পরিচিত দোকানদারকে জাল নোট দিয়ে থাকে। যাতে করে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। দোকানদার জাল নোট সনাক্ত করতে পারলেও পরিচিত মুখ দেখে কিছুই বলেন না। আর চিহ্নিত করতে না পারলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়। সাধারণ মানুষেরা ১০০ টাকা নোটের বিষয়ে তেমন উদ্বেগ প্রকাশ না করলেও ৫০০ ১০০০ টাকার নোটের বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকেন।

জাল টাকা প্রতিরোধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, ডিজিএফআই, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি, আদালত, সিকিউরিটিজ প্রিন্টিং প্রেস এর সদস্যগণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কাজ করলেও প্রতারক চক্রকে থামানো যাচ্ছে না। প্রতারক চক্র যে শুধু বাংলাদেশের টাকা জাল করে ক্ষ্যান্ত হচ্ছেন তা নয়, ভারতীয় রূপি, ডলার, ইউরোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জাল করে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এর সাথে মাফিয়া গ্রুপসহ আন্তর্জাতিক অনেক চক্র জড়িআেছে বলে গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। নৌপথ, স্থলবন্দও ও বিমান বন্দরকে কঠোরভাবে নজরদারিতে না আনা হলে অপরাধী চক্র আরো শক্তিশালি হয়ে উঠবে।

মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে জাল নোট চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হয়। কিন্তু আইনি দুর্বলতার কারণে কিংবা অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাগোযে তারা বেড়িয়ে যায়। সে জন্য জাল টাকার সাথে জড়িতদের শাস্তি হিসেবে ১০ বছর জেল বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান অর্থমন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। (বাংলাদেশ প্রতিদিন-২৬.০৬.২০১৫) মামলা হচ্ছে কিন্তু সাজা হয় না।

এসব মামলায় স্বাক্ষীর অভাব থাকে এ অযুহাত দেখিয়ে বছরের পর বছর মামলাকে ঝুলিয়ে রাখার দৃষ্টান্ত দীর্ঘ দিনের। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাদেশে জাল নোট বিষয়ে পৌনে ৬ হাজার মামলা ফাইলবন্দী হয়ে আছে। এসব মামলাকে দ্র্রত বিচার আইনে এনে কিংবা মোবাইল কোর্টের অধীনে স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে।

জাল টাকার উৎস বের করা না গেলে জাল নোট বন্ধ করার চেষ্টা অপূর্ণ থেকে যাবে। প্রতারক চক্রকে দীর্ঘ মেয়াদি জেল বা শারিরীক শাস্তির বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেয়া হলে তা হবে অর্থহীন। জাল টাকা তৈরীর চক্রকে রুখতে না পারলে তারা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে। লেন-দেনের সময় কোন নোট জাল পাওয়া গেলে তা গ্রাহককে ফেরত না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী জাল নোটকে ধ্বংস করাই বিধি সম্মত। কিছু কিছু জাল নোট এমন আছে যা খালি চোখে দেখে আসল-নকল পার্থক্য করা যায় না।

এ ক্ষেত্রে মেশিন কিংবা ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণে জাল নোট শনাক্ত করার ব্যবস্থা বাড়ানো উচিত। জনস্বার্থে সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জাল নোট সনাক্তকারি মেশিনের ব্যবহার, গুরুত্বপূর্ণ জনসমাগমস্থলে আসল নোটের বৈশিষ্ট্য সংবলিত হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং, অডিও-ভিডিও সাইন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচারণাকে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত পৌছে দেয়া উচিত। প্রজেক্টরের মাধ্যমে জাল টাকা আসল টাকার পার্থক্য দেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়া গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

জাল টাকা প্রতিরোধে ববহারকারীকেই আগে সচেতন হতে হবে। আসল নোট চিনতে পারা সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য। জাল টাকার সাথে জড়িত সকল ভাইদের অনুরোধ করে বলছি, আপনারা এই পথ থেকে ফিরে আসুন। কেননা জাল টাকার কারণে দেশের মুদ্রার মান পড়ে যায়, মূল্যস্ফীতি ঘটে। এভাবে দেশের অথনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া বাংলাদেশের জন্য হুমকি স্বরুপ। তাই দেশের কল্যাণে আপনারা প্রতারণামূলক কাজ থেকে বিরত থাকুন।

লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mabdulkahhar@gmail.com



মন্তব্য চালু নেই