জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে ৫৩ লাখ মানুষ

২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৫৩ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবেন সরাসরি, জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পানি, মাটি ও ফসলের ওপর৷ উপকূলীয় মানুষ হারাবেন বাসস্থান, বাড়বে পানীয় জলের সংকটও৷

তাই জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবিলায় ২০১০ সাল থেকে সাংগঠনিকভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ৷ এই খাতে ব্যয় করা হচ্ছে জিডিপির শতকরা একভাগ৷ কিন্তু এই অর্থ ব্যয় আর প্রকল্প নিয়ে এরই মধ্যে দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে৷ খোদ অর্থমন্ত্রী বলছেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় গঠিত তহবিলের অর্থ ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে৷”

জলবায়ু পরির্তনের হুমকির মুখে ৫৩ লাখ মানুষ

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে বর্তমান উপকূলীয় এলাকার ৪৩ লাখ মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবেন৷ আর ২০৫০ সালে এই হতভাগ্য মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩ লাখে৷

উপকূলীয় এলাকায় ৩ মিটার জলোচ্ছ্বাসে এখন ২০ লাখ মানুষ এর শিকার হন৷ এর চেয়ে বেশি জলোচ্ছ্বাস হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আরো ৬০ ভাগ বেড়ে হবে ৩২ লাখ৷ জানা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে৷ শুধু তাই নয়, তীব্র জোয়ারের সময় বাতাসের গতি এবং জমির ক্ষয় বেড়ে যাবে আরো ১০ ভাগ৷

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৫ লাখ গরিব মানুষ, যাঁদের মধ্যে ১৪ লাখ চরম দরিদ্র তাঁরা লবণাক্ত পানির কারণে পানীয় জল ও শুকনা মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পনি সংকটে আছেন৷ তার সঙ্গে পানির চরিত্রও পরিবর্তন হয়ে গেছে, বদলে গেছে পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্য৷ ২০৫০ সাল নাগাদ নাকি পানির এই লবণাক্ততা আরো বাড়বে৷ ৫২ লাখ গরিব মানুষ তখন এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবেন, যাঁদের মধ্যে ৩২ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে থাকবেন৷

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি ৩২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ৷ আশঙ্কার বিষয় হলো, এর মধ্যে চরম দরিদ্র দুই কোটি ৪৪ লাখ মানুষ তাঁদের মৌলিক প্রয়োজন খাদ্যের চাহিদা মিটাতে পারেন না৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দারিদ্র্য হার সবচেয়ে বেশি৷ ১৯টি উপকূলীয় জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি ১৮ লাখ৷

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার এই দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলে মনে করে ‘ক্লাইমেট প্রজেকশন অফ দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা৷ বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় এলাকার গরিব মানুষের জীবনধারণের জন্য চরম হুমকি৷

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) কাজ শুরু করে৷ পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন বছরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকি মোকাবিলায়, যা জিডিপির শতকরা ১ ভাগ৷

২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ২,৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই খাতে৷ তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে এই বরাদ্দ করা টাকা কমছে৷ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায় যে, আসছে অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা কমেছে৷

এ পর্যন্ত যে ২,৯০০ কোটি টাকা এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, তার মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ অর্থ বিভিন্ন প্রকল্প এবং ৩৪ ভাগ অর্থ জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলার কাজে লাগানো হয়েছে৷ ২,০০০ কোটি টাকায় ২১৮টি সরকারি এবং ৬৩টি বেসরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে৷ সরকারি ৫৬টি প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে৷ এছাড়া বেসরকারি প্রকল্পগুলো মনিটিরিং-এর দায়িত্বে আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)৷

প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের সময় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ৬,৭৬০টি ঘর, ৭৪০টি গভীর নলকূপ, ১৪২ কিমি. বাধ, ১২,৮৭২টি পরিবারের সৌর বিদ্যুৎ এবং মোট ১৪৩.৩৫ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কথা৷

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ এরইমধ্যে লবণ সহিষ্ণু ধান নিয়ে কাজ শুরু করেছে৷ ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষককে এই ধানের বীজ দেয়া হয়েছে৷ দেয়া হয়েছে চাষের প্রশিক্ষণ৷ তাছাড়া মাটি লবণ সহিষ্ণু হওয়ায় সূর্যমূখীর ফুলের আবাদও বেড়েছে৷ প্রসঙ্গত, সূর্যমূখী ফুলের বিচি থেকে ভোজ্য তেল পাওয়া যায়৷

তহবিল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ টিআইবি-র

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফান্ড নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে বরংবার৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি-র অভিযোগ, জলবায়ু তহবিলের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে৷ পারমাণবিক শক্তি, নবায়নযোগ্য এনার্জি ও সবুজ এনার্জি এক কাতারে ফেলে কার্বন গ্যাসমুক্ত জ্বালানি হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ তাদের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ঋণ নেয়া ৫৫টি এনজিও-র কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এছাড়া ১০টি নামসর্বস্ব, ১৩টি রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং মাত্র ১৭টি এনজিও ঠিকমতো কাজই করছে৷

এখানেই শেষ নয়৷ জলবায়ু তহবিলের অর্থায়ন নিয়ে রাজনীতিকরণ ও দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে টিআইবি৷ টাকা পাওয়া ১৩টি এনজিও-র নির্বাহী অথবা পরিচালনা পর্ষদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত৷ তাই রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে প্রকল্প পেয়েছে ৯টি এনজিও৷

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথায়, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় গঠিত তহবিলের অর্থ ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ তাই এক্ষেত্রে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি৷”

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘২০২০ সালের মধ্যে জিসিএফ-তহবিলের আকার ২শ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে, যার একটি অংশ বাংলাদেশও পাবে৷ কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷” সূত্রঃ ডিডাব্লিউ



মন্তব্য চালু নেই