ছায়ানটে চলছে বর্ষবরণ

তারুণ্যের জোয়ারে পূর্ণ হয়ে উঠেছে রমনা। উত্তাল ঢেউয়ের মতো চারিদিক দিয়ে দোল খেয়ে খেয়ে প্রবেশ করছে নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর, যুব-যুবারা। এ যেন লাল সাদার আলোর মিছিল।

উষার আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শতকণ্ঠে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন সূর্যকে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের আবাহনে কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো।’ তারপর একের পর এক দেশত্মবোধক, নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র গীতি আর কবিতার ঝর্ণাধারায় ¯œাত হয় নতুন সকাল।

নতুন সূর্যের আলোয় ভরে ওঠা নতুন বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দকে অভ্যর্থনা করা হয়। পাখির কলতান, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, রঙের আলো, আনন্দ খুশির হুল্লোরে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় রমনা। এ যে বাঙালির প্রাণের মেলা, বাংলার চির ঐতিহ্যের ধারক।

প্রেসক্লাব, সুপ্রিম কোর্ট, শাহবাগ, সোনারগাঁ হোটেল, বেইলি রোড, কাকরাইল মোড় আর মৎস্য ভবনের সড়ক ধরে সেই ভোর থেকে জোয়ারের মতো আসতে থাকে বাঙালির উত্তর প্রজন্ম। সঙ্গে অশিতপর বৃদ্ধা, ষাট বছরের পৌঢ় আর পঞ্চাশের ঘরে বয়সকে এলিয়ে দেওয়া বাবা-মায়ের হাত ধরে বর্ষবরণে চলে এসেছে নতুন প্রজন্ম। মনে হলো নতুনের কেতন ওড়াতে পুরাতনেরা এসেছে ঐতিহ্য বদল করতে। তাদের মননে লালিত বাঙালির ঐতিহ্য হাতে হাত রেখে বিনিময় করে যাচ্ছে তারা।

শুধু কি বাঙালি, এবারের বর্ষবরণে এসেছে বিদেশি অনেক অতিথিও। প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে একটি জাতির শেকড়ের চিরায়িত আচার-অনুষ্ঠান কতটা নান্দনিক হতে পারে।

‘হ্যালো’ বলতেই, ভাঙা ভাঙা বাংলায় শুভ নববর্ষ বলে ফিক করে হেসে দিলেন রাশান যুবা অ্যালেক্স জোকিভ। ওই হাসিতে ছিল শুধুই নির্মল আনন্দ আর দুচোখে ভরা বিস্ময়। এতো মানুষের আনন্দে সেও আত্মহারা।

সানারপাড়া থেকে এসেছে তিথি। রিকশা তাকে নামিয়ে দিয়েছে শিল্পকলা একাডেমির সামনে। মৎস্য ভবনের এই পথটুকু হেঁটে আসতে হবে। কচি কোমল পায়ে লাল শাড়ি পড়ে সাত বছরের তিথি কী দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে চলেছে রমনার পানে।

আসিকুর রহমান এসেছেন মালিবাগ থেকে। খুব কাছাকাছি হলেও আগে আগে এসেছেন তার পরিবার নিয়ে। দুই মেয়ে আনিকা, নিলম আর ছেলে শাহীনকে নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘আসলে পয়লা বৈশাখ হৃদয়ের গহিন থেকে নাড়া দেয়। তাই যত কষ্ট হোক ছুটে আসি। বলতে পারেন, রক্তে এই ঐতিহ্য মিশে আছে। এটাকে পূর্ব পুরুষেরা পালন করে গেছেন। আমরাও পালন করছি। আর নিজেই হাত ধরে এই নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে যাচ্ছি, আমাদের জন্ম জন্মান্তরের ঐতিহ্য কীভাবে পালন করতে হয়।’

তখন কেবল সাড়ে ৭টা বাজে। রমনা পার্কের চারিদিকে লাগানো গ্রামোফোনের মাইকে বটতলা থেকে ছায়ানটের গানের সুর ভেসে চলছে। সেই সুরের মুর্ছনায় মাতোয়ারা পুরো এলাকা।

অসংখ্য, অগুণিত তরুণ, যুবক-যুবতীর লাল-সাদা পোশাকে বিন্যস্ত রমনা যেন এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত বনবিথী। খুশি আর অনন্দে ভাগাভাগি করে আরো আনন্দময় করে তুলেছে নতুন বছরকে।

পুরাতন সব জরা জীর্ণতা ভুলে তারা নতুনকে বরণ করতে চায়। নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত করতে চায় এক নতুন পৃথিবী।

সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে ছায়ানটের অনুষ্ঠান। তারপরই রেইন্ট্রি তলায় রবিরাগের অনুষ্ঠান। ওখানকার আয়োজক বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শিবলী সাদিক। তিনি বলেন, ‘ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হলেই তারপর তারা শুরু করবেন।’

এদিকে এশিয়ানো রেঁস্তরার পূর্বপাশে জাম তলায় বিশাল আয়োজন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের। এখানে দুপুর পর্যন্ত একটানা চলবে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই শুরু করার কথা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া রমনার মধ্যে আর তেমন কোনো বিনোদনের সুযোগ রাখা হয়নি।

রমনা সংলগ্ন শিশুপার্ক বর্ষবরণ উপলক্ষে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হাজারো শিশুর আনন্দ খুশিতে পার্কটিও যেন একটু আনন্দিত। কারণ অন্য সময় এই সব কোমলমাতি শিশুদের জন্য অপেক্ষায় থাকে পার্কটি।

আনন্দ ঐতিহ্য সব মিলিয়ে যেন এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে রমনা। আর এই মিলন বাঙালির প্রাণের, ভালোবাসার আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দিয়ে গড়া নতুন এক বাংলাদেশের জন্য।



মন্তব্য চালু নেই