চূড়ান্ত ফল নিয়েই ফিরবে বিএনপি
যে কোনো মূল্যে চলমান আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল চাচ্ছে বিএনপি। বর্তমান কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার কোনো চিন্তাভাবনা নেই দলটির। উল্টো চলমান আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করতে দলের সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরকে আরও সক্রিয় করতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। আজ বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই সরকারের হার্ডলাইন মোকাবেলায় পাল্টা কৌশল বাস্তবায়নে নানা দিকনির্দেশনা দেয়া হবে জোটের নেতাকর্মীদের। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র আরও জানায়, রাজপথ উত্তপ্ত রাখার পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারে চলছে নানা উদ্যোগ। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন মাধ্যমে চালানো হচ্ছে ব্যাপক তৎপরতা। এ মুহূর্তে বিএনপির ওপর অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর পর্যাপ্ত আস্থা রয়েছে বলে মনে করেছেন শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা। আন্দোলন নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনড় ও দৃঢ় অবস্থান নেতাকর্মীদের মধ্যেও সৃষ্টি করেছে প্রাণচাঞ্চল্যের। চলমান আন্দোলনে ইতিবাচক ফল আসবে- এমন আÍবিশ্বাসও ফিরে পাচ্ছেন তারা।
আরও জানা গেছে, দু-একদিনের মধ্যেই আন্দোলনের গতি বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকার বাইরে আন্দোলনকে আরও বেগবান করা হবে। ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নেয়া হয়েছে। প্রতিটি মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পিকেটিং বাড়ানো হবে। ঢাকার বাইরে থেকে যাত্রীবাহী বাসসহ কোনো পরিবহন যাতে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন স্থানে পাহারা বসানো হবে। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট জেলা নেতাদের এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পর রাজধানীতে শুরু করবে চূড়ান্ত অ্যাকশন।
দলীয় সূত্র জানায়, উল্লিখিত সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কয়েক স্তরে নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম সারির কেউ গ্রেফতার হলে, দ্বিতীয় সারির কে দায়িত্ব পালন করবে তাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত অ্যাকশনে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কেউ যাতে গ্রেফতার না হন হাইকমান্ড থেকে সে রকম নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। বিশ্বস্ত নেতাকর্মী ছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্তরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। সরকারের ক্রাক ডাউনকে সামনে রেখে অনেকে তাদের আগের অবস্থানও পরিবর্তন করেছেন। সেই সঙ্গে মোবাইল নম্বরও।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, তারা বিরামহীন আন্দোলনের মধ্যে আছে। যতদিন দাবি আদায় না হবে, এ আন্দোলন আরও বেগবান করা হবে। তিনি বলেন, চলমান আন্দোলনে এবার একটা ফল আসবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ আন্দোলনে দিনে দিনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে। সরকার দমন-পীড়ন চালিয়ে গণআন্দোলনকে দাবাতে পারবে না।
জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ২০ দলের নেত্রী খালেদা জিয়া অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হতে নয়, দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতেই এ আন্দোলন। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জনগণ যে কোনো সংগ্রামে অংশ নিতে কিছুটা সময় নেন। একবার যদি তারা ঘর থেকে বের হন, তবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফেরেন না। ২০ দলের আন্দোলনেও দিন দিন জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে। কোনো হুমকি-ধমকি দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। অলি আহমদ বলেন, আন্দোলন চলাকালে আলোচনায় বসতে কোনো বাধা নেই। তবে আন্দোলন বন্ধ করে কোনো আলোচনায় যাবেন না তারা।
সূত্র জানায়, এবারের আন্দোলনকে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে দেখছে দলের নেতাকর্মীরা। নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে গিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ শুরু করার চেষ্টা করছেন। ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। নানাভাবে তা নিরসনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকে সামনে রেখে নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। যার প্রমাণও রাজপথে পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেই মিছিল ও পিকেটিং করে তারা। সক্রিয় হচ্ছে বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও।
বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক জানান, জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীও এবারের আন্দোলনকে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে নিয়েছে। তবে এখনও রাজপথে তাদের পূর্ণ শক্তি দেখা যায়নি। কয়েকটি জেলায় সক্রিয় থাকলেও সার্বিকভাবে জামায়াতের ভূমিকায় এখনও আশান্বিত হতে পারছে না বিএনপি। কিভাবে জামায়াত-শিবিরকে রাজপথে আরও সক্রিয় করা যায় সে ব্যাপারে কাজ চলছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা জামায়াতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনে তারা রাজপথে সর্বশক্তি দিয়ে নামবেন বলে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত-শিবির রাজপথে নামলে আন্দোলন আরও বেশি বেগবান হবে বলে তাদের বিশ্বাস।
ওই নীতিনির্ধারক আরও জানান, রাজপথে আন্দোলনকে বেগবান করার পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারেও নানামুখী চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কূটনৈতিক দেখভালে দায়িত্বপ্রাপ্ত শমসের মবিন চৌধুরী গ্রেফতার ও রিয়াজ রহমান গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাতে কিছুটা ছেদ পড়ে। কিন্তু আগে থেকেই কয়েক স্তরে কূটনৈতিক দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম সারির কেউ গ্রেফতার হলে পরে কারা দায়িত্ব পালন করবে, সে পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের বাসায় কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া বহির্বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুককে আগেই সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তাদের অবহিত করছেন। সেখানে চিকিৎসাধীন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাও এ ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই কাজ করছেন। তার পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল কয়েক মাস আগে ভারতের জনতা পার্টিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপির পক্ষে নয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত যাতে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখে সে লক্ষ্য নিয়েই তারা কাজ করছেন। চলমান আন্দোলনে ইতিমধ্যে প্রাথমিক সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা। নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ২০ দলের পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ জোরালো বক্তব্য রাখছেন। এ ইস্যুতে দ্রুত সংলাপে বসতে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। একই সঙ্গে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সরকারকে নানাভাবে চাপে রাখছেন। সবশেষ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন শুক্রবার এক বিবৃতিতে দেশের সংঘাত বৃদ্ধির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তা নিরসনে উদ্যোগ নিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের এমন বিবৃতিকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবেই দেখছে তারা। তাদের এ বিবৃতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে দলটি। চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করা গেলে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর আরও চাপ আসবে বলেও বিশ্বাস তাদের।
বিএনপির ও ২০ দলীয় জোটের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী টানা অবরোধে দল ও জোটের নেতাকর্মীদের পারফরম্যান্সে খুশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রতিনিয়তই নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়ে আসছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। একইভাবে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সাহস জোগাচ্ছেন। দলের চেয়ারপারসনের এমন অনড় ও দৃঢ় অবস্থান এবং তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা পেয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যেও চাঙ্গা ভাব দেখা যাচ্ছে। বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে সক্রিয় ছিলেন না তারাও নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপির পাশাপাশি শনিবার জোটের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই