‘চাপ স্থিতিশীলতার জন্য, নির্বাচনের জন্য নয়’

চলমান সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ গত ক’দিনে এ নিয়ে একাধিকবার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে৷ কিন্তু এই চাপ বাংলাদেশকে একটি নতুন নির্বাচনের দিকে নেবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন৷

ওয়াশিংটনে বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ সহিংসতা বন্ধ এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের তাগিদ দিয়েছেন তিনি৷

একই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গেও সাক্ষাত্‍ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী৷ বেঠকে জন কেরি বাংলাদেশে চলমান সহিংসতা বন্ধে সরকারকে শান্তিপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান৷

তিনি বলেন, ‘‘সব দলকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে৷” এছাড়া মানবাধিকার পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য স্বাধীন ও স্বচ্ছ গণমাধ্যমের প্রতিও জোর দেন তিনি৷

ঢাকা সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজনৈতিক সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে৷ তবে সরকার জানিয়েছে যে, সহিংসতা বন্ধের আগে কোনো সংলাপ নয়৷

গত বছরের ৫ই জানুযারি একতরফা নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়৷ বিএনপি এই নির্বাচন তখন বর্জন করে৷ তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল৷ গত একবছর এই দাবি নিয়েই তারা সেচ্চার ছিল৷ তবে একরফা নির্বাচনের বছরপূর্তিতে তারা নতুন করে আন্দোল শুরু করেছে৷ ৬ই জানুযারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে তারা৷ এই কর্মসূচি অব্যাহত রেখেই এখন লাগাতার হরতাল কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট৷

বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস উইং-এর কর্মকর্তা শাইরুল কবির খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘খালেদা জিয়া দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না৷ তাতে যতদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ততদিন আন্দোলন চালাবেন তিনি৷”

হরতাল-অবরোধে বাংলাদেশে গত দেড়মাসে ৮২ জন নিহত হয়েছেন৷ এরমধ্যে পেট্রোল বোমায় নিহত হয়েছেন ৫২ জন৷ এছাড়া এক হাজারেরও বেশি যানবাহন আগুন অথবা পেট্রোল বোমা ছুড়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে আটকে রেখেছে পুলিশ৷ যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে, তবে সোমবার তিনি বাইরে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁর গেটে তালা লাগিয়ে দেয়৷ ফলে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন গেটের মধ্যেই৷

সরকার এখন পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনকে আমলেই নিচ্ছে না৷ আর সংলাপের ব্যাপারেও তাদের দিক থেকে নেই কোনো ইতিবাচক সাড়া৷ তারা সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে দমনের কথা বলছে৷ বিএনপি অবশ্য সহিংসতার জন্য সরকারকেই দায়ী করছে৷ তারা বলছে, সরকার নিজেই সহিংসতা করে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে৷

এই যখন পরিস্থিতি তখন আন্তর্জাতিক চাপ কী কোনো সমাধান দেবে? আর সেই সমাধান কোন পর্যায়ের –শুধু কী পরিস্থিতি শান্ত করা, না সঙ্গে নতুন একটি নির্বাচনের কথা বলবে তারা?

এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দি খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে কথা বলছে বলেই আমার মনে হয়৷ এ জন্য তারা সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার কথা বলছে৷ কিন্তু নতুন বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে না৷”

তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় তারা নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করছে৷ তারা হয়ত চাইছে, রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি ঠিক করুক৷”

হাফিজ উদ্দিন খান মনে করেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত হয়ত সরকার সংলাপে রাজি হবে৷ তবে নতুন মধ্যবর্তী নির্বাচনে রাজি হবে না বলেই আমার মনে হয়৷ ফলে সংকট হয়ত কাটবে না, তবে সামাল দেয়া যাবে৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ অর্থনীতিসহ নানা কারণে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার কাছে গুরত্বপূর্ণ৷ তাই তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশলিতা দেখতে চায়৷ তারা এখানে অস্থিতিশীল পরিবশে বা সহিংসতা চায় না, এটা নিশ্চিত৷ তবে সহিংতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে বাংলাদেশ কিভাবে বেরিয়ে আসবে – সেই ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়৷”

তিনি বলেন, ‘‘তারা সরকার এবং বিএনপি উভয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷ তাদের বক্তব্য শুনছে৷ তারপর দুই দলকেই খুশি রাখতে একটি মাধ্যবর্তী অবস্থান থেকে কথা বলছে তারা৷ বলছে সংলাপের কথা৷”

ড. শফিউল আলম বলেন, ‘‘নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা কথা বলবেন না এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ তারা চান এটা রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক করবেন কিভাবে সংকট কাটানো যায়৷ তারা কোনো দলের পক্ষেই অবস্থান নেবে না৷ তারা তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে৷ তাই তারা এমন পরিস্থিতি চায়, যাতে তাদের স্বার্থের কোনো ক্ষতি না হয়৷”

তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সহসা সমাধান হবে বলে মনে হয় না৷ এখনো তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ডি ডব্লিউ



মন্তব্য চালু নেই