গুলশান হামলার সন্দেহভাজন সেই ৪ জঙ্গি কোথায়?

ভাড়াটিয়া পরিচয়ে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী চার যুবক তিনমাস যাবৎ রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম শেওরাপাড়ার ৪৪১/৮ নম্বরের চারতলা বাড়ির নিচ তলায় অবস্থান করছিল। তারা বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের সাথে তেমন মেলামেশা করত না। কখন আসত, কখন যেত বা কতক্ষণ থাকত তা অন্য ভাড়াটিয়ারা জানতেন না। ঈদের দিন অল্প সময়ের জন্য প্রতিবেশীরা তাদের দেখলেও এরপর থেকে কোনো খোঁজ নেই। ডিবি পুলিশ ওই বাসায় দ্ইুবার অভিযান চালিয়ে বাসার মালিককে গ্রেফতার করলেও জঙ্গিদের ব্যাপারে কিছু বলছে না। খবর পরিবর্তনের।

এ চার যুবককে গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গি এবং জঙ্গিদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি, ডিএমপি)। তাদের ম“দাতা হিসেবে ঐ বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মো. নুরুল ইসলামকে (৬৫)গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। আটক বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গি ও তাদের সহযোগিদের বাসা ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে অভিযানে চালিয়ে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত পশ্চিম শেওরাপাড়ার ৪৪১/৮ বাড়ি থেকে গ্রেনেড ও জঙ্গিদের ব্যবহৃত অন্যান্য আলামত উদ্ধারকালে তাকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র, মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে কথা হয় পাশের ফ্ল্যাটের পোশাক শ্রমিক মো. মামুন (২৮) এর সাথে। তিনি প্রায় এক বছর যাবৎ এই বাড়ির নিচ তলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।

মামুন জানান, নিচতলার প্রথম রুমটিতে চারজন ব্যাচেলর থাকত। যাদের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে হবে। ঐ যুবকদের সাথে প্রথমাবস্থায় মাত্র দু’বার কথা হয়েছে তার। তখন জানতে পেরেছেন যুবকরা মিরপুর বাঙলা কলেজে পড়াশোনা করে।

তিনি আরো জানান, সর্বশেষ ঈদের দিন ঐ যুবকদের এ বাসায় আসতে দেখেছেন। বাড়িওয়ালার সাথে তারা কেন জানি রাগ করেছিল। বাড়িওয়ালা তাদের সেমাই খেতে ডাকলেও তারা যাচ্ছিল না। পরে আমি আমার কাজে চলে যাই।

এছাড়া তাদের বিষয়ে আর কোনো তথ্য দিতে পারেননি মামুন। ঐ সময় নাম জিজ্ঞেস করলেও তাদের সাথে মেলামেশা না থাকায় নামগুলো মনে রাখতে পারেননি বলেও জানান মামুন।

মামুনের ফ্ল্যাটের একটি রুমে সাবলেট হিসেবে ভাড়া থাকেন গ্রিন ইউনিভার্সিটির ল’ ডিপার্টমেন্টের শেষ পর্বের ছাত্র মো. সাজিব হোসেন সাদ্দাম (২২)। তিনি বলেন, ‘গতরাতে (শনিবার) সাড়ে ১২টার দিকে ডিবি লেখা বিশেষ পোশাক পরিহিত ১০/১২ জন এসে বাসায় তল্লাশি চালায়। আমাকেসহ আরো কয়েকজনকে ডেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেয়। এসময় সেই রুম থেকে একটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও একটি সিলিং ফ্যানও নিয়ে গেছে ডিবির সদস্যরা।’

সাদ্দাম আরো বলেন, ‘৪ দিন আগেও একবার ডিবি পুলিশের লোকজন এসে রুমটির তালা ভেঙে তল্লাশি চালিয়ে কালো পাঞ্জাবী, টুপি, একটি ফ্যান, কাপড়-চোপর, সেণ্ডেলসহ বেশ কিছু ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র নিয়ে যায়।’

অপর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বিবি কহিনুর (৪৫) জানান, ঐ বাসায় কয়েকজন ছেলে থাকে বলে জানতাম। কিন্তু আমাদের সাথে তাদের কখনও কথাবার্তা হয়নি। তারা ব্যাচেলর হিসেবেই থাকত। কখন আসত, কখন যেত তার ঠিক নাই। বাসায় আছে কি নাই তাও বোঝা যেত না। দরজা সব সময় ভেতর থেকে বন্ধ থাকত। ঈদের সময় তারা চলে গেছে বলে জেনেছি। আর দেখিনি।

৪ দিন আগে একবার পুলিশের লোকজন এসেছিল। গতরাতেও (শনিবার) এসেছিল। বাসাটি তল্লাশি চালিয়ে যাওয়ার সময় বাড়িওয়ালাকেও সাথে নিয়ে গেছে। কহিনুর জানান, তাদের বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ।

পাশের বাসার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা নাম প্রকাশ না করে জানান, ‘বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ। ব্যাচেলর ছেলে ছোকরাদের বাসা ভাড়া দিয়ে বিপদে পড়েছেন। এভাবে হলে তো ব্যাচেলর ছেলেদের বাসা ভাড়াই দেওয়া যাবে না।’

এ বিষয়ে কথা বলতে বাড়িওয়ালার স্বজনদের খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। দোতলায় বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটটিতে তালা মারা দেখা গেছে। তবে ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন বাড়িওয়ালার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে ও ছেলের বৌ পড়াশুনো করেন। তারা এখানেই থাকেন। তবে মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। তার জামাতা র‌্যাবের কর্মকর্তা পর্যায়ে কর্মরত বলেও জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা।

এ ব্যাপারে জানতে রোববার দুপুর ১টার দিকে ফোন দিলে মিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ভূইয়া মাহবুব হোসেন জানান, তিনি এ অভিযান সম্পর্কে কিছু জানেন না। ডিবি এ অভিযান চালিয়েছে।

পরে বেলা দুইটার দিকে ওসি ভূইয়া মাহবুব হোসেন সংশ্লিষ্ট বিট অফিসার ও সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। এসময় তিনিও ভবনের অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের কাছে নাম পরিচয় ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি তখন আবারো জানান, নিয়ম হলো কোনো সংস্থা অভিযান চালালে থানাকে ইনফর্ম করতে হয়। কিন্তু ডিবির এ অভিযানটি সম্পর্কে তাদের জানানো হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট বিট অফিসার (উপ পরিদর্শক) তাপস কুমার বিশ্বাসের বরাত দিয়ে ওসি জানিয়েছেন, এই বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। আমরা সেগুলো তদন্ত করে দেখব।

দু’দফায় অভিযান চালানোর বিস্তারিত তথ্য, ভাড়াটিয়া ও সেই সন্দেহভাজন চার জঙ্গিদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা জানতে রোববার বিকেলে একাধিকবার ফোন দিলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র, মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান ফোন রিসিভ করেননি।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পাঠানো মুঠোফোনের খুদে বার্তায় জানানো হয়, তথ্য না জেনে ‘জঙ্গি’দের বাড়ি ভাড়া দেওয়া ও তাদের ব্যাপারে তথ্য গোপন করার অভিযোগে রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে মো. নুরুল ইসলাম নামের এক বাড়িওয়ালাকে আটক করেছে পুলিশ। এসময় ওই বাড়ি থেকে ‘জঙ্গি’দের হাতে বানানো গ্রেনেড, কালো পোশাকসহ ব্যবহার্য কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

১ জুলাই রাত নয়টার দিকে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে অন্তত ২০ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসী-পুলিশ গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। গোলাগুলির ওই ঘটনায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাহউদ্দিন নিহত হন।

পরদিন ২ জুলাই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’নামে বিমান, নৌ বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশের সমন্বিত অভিযান চালানো হয়। সারা রাত অবস্থানের পর সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হওয়া কমান্ডো অভিযানে ১২/১৩ মিনিটের মধ্যে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে টার্গেট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

এদিকে ঘটনার পর তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) গুলশানের হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিতর্কিত সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।



মন্তব্য চালু নেই