গরমে অজ্ঞান পার্টির ‘ঠাণ্ডা আয়োজন’
পুরান ঢাকার নয়াবাজারে একটি কাগজের দোকানের ব্যবস্থাপক গুলজার হোসেন। তিনি গত ১২ মে ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যান। কাজ শেষে বাসে ফেরার পথে শসা কিনে খান তিনি। এর পরই অচেতন হয়ে পড়েন। গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের সামনে থেকে তাঁকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পথচারীরা। কিছুটা সুস্থ হলে গুলজার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, কৌশলে অজ্ঞান করে দুর্বৃত্তরা তাঁর কাছে থাকা আড়াই লাখ টাকা নিয়ে গেছে।
গত এক মাসে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গুলজারের মতোই অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কমপক্ষে ২০০ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে একজন। লাখ লাখ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খুইয়েছে প্রায় সবাই। লেবু ও ফলের শরবত, ডাবের পানি, খাবার পানি, জুসের প্যাকেট, শসা, ক্ষীরা, তরমুজ, গাজর, কোমল পানীয়সহ গরমে স্বস্তিদায়ক খাবার খেয়ে বা পানীয় পান করেই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা বলছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে বাইরে ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার ও পানীয় পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। যাত্রাপথে বিভিন্ন গণপরিবহনের যাত্রীদের কৌশলে খাবার ও পানীয় পণ্যের সঙ্গে চেতনানাশক সরবরাহ করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, পাইকারি বাজার ও বিপণিবিতানগুলোতে অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এমন ৪০টি স্পট এবং এসব স্পটে সক্রিয় ৩০টি অজ্ঞান পার্টিকে শনাক্ত করেছে গোয়েদা পুলিশ (ডিবি)। একেকটি গ্রুপে ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির অন্তত ৪০০ সদস্য সক্রিয় রয়েছে। পুলিশের অভিযানে কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের অপকর্ম করছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। এ ধরনের অপরাধীদের ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাঁদের। তবে বাস্তবতা হলো, ছয় মাস ধরে পুলিশের অভিযান চললেও অজ্ঞান পার্টির হোতারা ধরা পড়ছে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে ১০ জন করে মানুষ অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সেখানে ভর্তি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারও এক দিনে ভর্তি হয়েছে ১০ জন। গত ৬ মে গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় কর্মরত বিআইডাব্লিউটিসির প্রকৌশলী ফয়জুর রহমানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জানা গেছে, অফিসের কিছু জিনিস কেনার জন্য তিন লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন ফয়জুর। বাসে আসার সময় তিনি জুস কিনে পান করার পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই ফাঁকে তাঁর কাছে থাকা তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
গত ৬ মে রাজধানীর রাজারবাগ কালীবাড়ির সামনে থেকে আবদুর রাজ্জাক নামের এক অটোরিকশাচালককে শসা খাইয়ে অজ্ঞান করে তাঁর গাড়িটি নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টি। একই দিন ডেমরার পাইটিতে আলেয়া বেগম ও তাঁর মেয়ে ইভাকে চেতনানাশক মেশানো তরমুজ খাইয়ে অচেতন করে দুই লাখ টাকা ও ১০ ভরি সোনার গয়না নিয়ে চম্পট দেয় প্রতারকচক্র। আলেয়া বেগমের বড় মেয়ে ফারজানা আক্তার জানান, নিজেদের তিনতলা বাড়ির দোতলায় থাকেন তাঁরা। ওই দিন তাঁদের তিনতলার ফ্ল্যাটে দুই নারী ও এক পুরুষ ভাড়াটিয়া ওঠে। কাজের তাগিদে বাসার পুরুষরা বাসার বাইরে গেলে দুপুরে তাঁর মা ও বোনকে তরমুজ খাওয়ায় নতুন ভাড়াটিয়া মহিলারা। এরপর ওই দুজন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর ভাড়াটিয়াবেশী ওই মহিলারা বাসা থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. খাজা গফুর বলেন, এখন সাধারণত পানীয় বা ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার খেয়েই বেশির ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে। গরমে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এ ধরনের খাবারে চেতনানাশক মেশাচ্ছে। তারা বেশি ব্যবহার করছে এপিট্রা নামের একটি তরল ওষুধ ও নকটিন ট্যাবলেট। ঘুমের ওষুধ এটিভেন, মাইলাম, ডরমিকামও ব্যবহার করা হচ্ছে। কখনো কখনো দুর্বৃত্তরা ধুতরা জাতীয় বনজদ্রব্যও ব্যবহার করে। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের ইনসুলিনও ডাবের পানিতে মেশানো হচ্ছে। এতে ব্লাড সুগার কমে গেলে যে কেউ অচেতন হয়ে পড়তে পারে। এক ফোঁটা এপিট্রা মেশানো খাবার খেলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসবে। অতিরিক্ত সেবনে কোনো ব্যক্তি দুই থেকে তিন দিনও অজ্ঞান অবস্থায় থাকতে পারে। এ ছাড়া শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি অতিরিক্ত সেবনে মারাও যেতে পারে।
গত ২৯ এপ্রিল কমলাপুরে আকবর আলী (৪০) নামের গাজীপুরের কালিয়াকৈরের এক ব্যক্তি এভাবে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে শেষ পর্যন্ত মারা যান।
ধরা পড়ছে না ওরা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং ফার্মগেট, শাহবাগ, কল্যাণপুর, শ্যামলী, ফকিরাপুল, মিরপুর, পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি জনবহুল এলাকায় অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বেশি। অজ্ঞান পার্টির ৩০টি গ্রুপে ৪০০ সদস্য সক্রিয় আছে। দলনেতাদের মধ্যে আহসান আলী, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, আব্দুল সালাম, শেখ আবু জাফর, জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ শহিদুল ইসলাম ওরফে বাবু, বোরহান শেখ, রফিজ শিকদার, মিন্টু শিকদার, শফিকুল সমাদার, মিল্টন শিকদার, হুমায়ুন, আনোয়ার হোসেন, এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, মাওলা, রিপন মৃধা, ফজলুর রহমান উল্লেখযোগ্য।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অনেক কৌশলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তার করে হত্যাচেষ্টা, চেতনাহীন করা ও চুরির মামলা দেওয়া হয়। তবে আদালত থেকে সহজেই ওরা জামিনে বেরিয়ে যায়।
সর্বশেষ গত বছরের ২৭ নভেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অজ্ঞান পার্টির ৩১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এর আগে গত বছরের ১ অক্টোবর ধানমণ্ডিতে অজ্ঞান পার্টির ছয় সদস্যকে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ২ অক্টোবর মতিঝিলে দুটি অভিযান চালিয়ে দলনেতা মোহাম্মদ আলম, চান মিয়াসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ৩ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ থেকে আরো ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৮ মে অজ্ঞান পার্টির দলনেতা মিন্টু শিকদারসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র, যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ‘অজ্ঞান পার্টির মূল টার্গেট টার্মিনালগুলো। ঈদের সময়ই তারা বেশি সক্রিয় থাকে। গরমেও কিছুটা তৎপরতা বাড়ে। আমরা সব সময় নজরদারি করছি। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। বাইরের খাবার গ্রহণে সবারই সাবধান হওয়া উচিত।-কালের কণ্ঠ
মন্তব্য চালু নেই