গণমাধ্যম মুক্ত, আমাদের ‘কলম’ শৃঙ্খলিত
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস `World press freedom day’ বাক্যটি শুনতে কতই না ভালো লাগছে! আজ আমরা সবাই মুক্তভাবে নিজের মনের ভাব, চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করতে পারবো, তাই না? কিন্তু বাস্তবতা কী, আমরা যারা কোনো না কোনোভাবে গণমাধ্যমের সাথে জড়িত তারা অবশ্য খুব সহজেই অনুভব করতে পারছি এই বিশ্ব মুক্ত দিবসের স্বাধীনতার মর্মার্থ।
সেই ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩রা মে তারিখটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ অথবা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে ব্যাপক ঢামাঢুলের সাথে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্থ ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এই দিবসটিতে।
বছর শেষে দিবসটি ফিরে আসলেই আমাদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো কমতি থাকে না। বিশেষ করে সাংবাদিক মহলে অনেকটা এ দিবসটি অনাড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু দিবসটি ঘোষণার ২২ বছর পরে আজ যদি আমাদের সাংবাদিক ভাইদের কাছে প্রশ্ন করা হয়- আপনারা কতটা স্বাধীন এবং আপনাদের কর্মক্ষেত্র গণমাধ্যম কতটা শৃঙ্খলমুক্ত? আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ প্রশ্নটির জবাব দেয়ার আগে সবাইকে একবার হলেও চিন্তা করতে হবে। জানি তারা কী উত্তর দিবেন।
প্রসঙ্গত, অন্যের কথাই বাদ দিলাম, নিজের কথায় আসি। আপনারা হয়তো সবাই জানেন, আমি নিজে বিভিন্ন বিষয়ে কমবেশী লেখালেখির চেষ্টা করি। সেহেতু মুক্ত গণমাধ্যমের বিষয়ে আমার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করি কেমন!
মাস তিনেক আগে দেশের প্রভাবশালী একটি পত্রিকায় আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হবার পর অন্য একটি স্বনামধন্য পত্রিকা থেকে ই-মেইলে আমাকে অনুরোধ করা হলো আমি যেন তাদের পত্রিকায় লেখি। যথারীতি আমার দুটি নিবন্ধ প্রকাশ এবং আমাকে সম্মানিও দেয়া হলো। কিন্তু তৃতীয় নিবন্ধটি প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলো। কী ঘটেছে সেটা না হয় এখানে নাই বা উল্লেখ করলাম। পাঠকদের হয়তো সেটা বুঝতে সমস্যা হবে না। এরপর থেকে সেই পত্রিকায় আমার দ্বারা আর লেখা পাঠানো হয় না।
কিছুদিন আগে অপর একটি জাতীয় দৈনিকের (সাকুর্লারেরে দিক থেকে সেরা ৪/৫ মধ্যে একটি) একজন সিনিয়র সাবএডিটরের সাথে লেখার বিষয়ে আমার কথা হয়। প্রথমেই তিনি আমাকে যা বললেন ‘এখানে সরকারের সমালোচনামূলক কোনো লেখা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর এটা মাথায় রেখে আপনাকে লেখা লিখতে হবে। সেটা করলে আপনার যে কোনো লেখা প্রকাশ করতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’ অবশ্য তাদের সেই অসিয়ত মেনে আমার বেশ কয়েকটি নিবন্ধ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
থাক এসব কথা। এবার আসি সাংবাদিক বন্ধু মহলের কথায়- আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় কাজ করেন। বর্তমানে তারা ঢাকা শহরের সনামধন্য সাংবাদিক। সাংবাদিকরা তো দেশ-বিদেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে সর্বদা ওয়াকেবহাল থাকেন, সেই ধারণা থেকেই আমি মাঝে মধ্যেই তাদের সাথে যোগাযোগ করি। কথা প্রসঙ্গে একদিন আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সনামধন্য সাংবাদিক (নাম প্রকাশ করা ঠিক হবে না) তাকে প্রশ্ন করি- তোমরা তো অনেক বড় সাংবাদিক, তবে কতটা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছো? আমার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি যা উত্তর দিলেন তা হতবাক হওয়ার মতো। তিনি বললেন- আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, আছে মালিকের স্বাধীনতা। মালিকের পলিসি অনুসারে কাজ করতে না পারলে কোথা্ও চাকুরি করা সম্ভব নয়।’
অপর এক বন্ধু একই ধরনের প্রশ্নের জবাবে বললেন- ‘গণমাধ্যম মুক্ত কিন্তু আমাদের কলম শৃঙ্খলিত’ চাকুরিতে যোগদানের সাথে সাথেই আমাদেরকে এক ধরনের অসিয়ত নামা দেয়া হয়- কী কী বিষয়ে নিউজ করা যাবে, আর কী কী করা যাবে না। ফলে সেই অসিয়ত মেনেই আমাদেরকে কাজ করতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে রক্ষা নেই। ফলে বুঝতেই পারছেন আমরা কতটা স্বাধীন!
এক কথায় তাদের সাথে কথা বার্তায় যা বুঝতে পারলাম তাতে- আমাদের দেশে বর্তমানে যে কয়টি মিডিয়া রয়েছে তা মূলত পূঁজিপতিদের মালিকানায়। আর এই পূঁজিপতিরা কোনো না কোনো দল বা গোষ্ঠীর অনুগত তাবেদার। ফলে তারা যেভাবে মিডিয়া তথা সাংবাদিকদের পরিচালনা করছেন সেভাবেই চলছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো। এই তো মুক্ত-গণমাধ্যম ও মুক্ত সাংবাদিকতা, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস!
এরপরও সাংবাদিকদের ওপর হামলামামলা তো আছেই। নানাভাবে গণমাধ্যম কর্মীরা হচ্ছেন লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত। নিরাপত্তার অভাবে গণমাধ্যম হয়ে পড়ছে কোনঠাসা; আর শাসক-কর্তাদের রক্তচক্ষু, আমলাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং দুনীতিবাজ ও চেরাকারবারীরা গণমাধ্যম কর্মীদের দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ এবং ১৪ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বিশ্বে ১০৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন; আর গত এক দশকে প্রায় ৭শ’ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের অবস্থা এর বাইরে নয় । গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল, এই সময়ের মধ্যে ১১জন সাংবাদিককে নিহত হয়েছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন আরো প্রায় ১০৯৩ জন সাংবাদিক। ফরহাদ মাজহার ও সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির করুণ পরিণতির কথা তো আমাদের সবারই জানা।
এরপরও আমরা আজ যখন বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি তখন আমার দেশ’র সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রায় দুই বছর ধরে জেলে আটক, তেমনি ৩ মার্চ থেকে ইটিভির সাংবাদিক কনক সারো্ওয়ার এবং ৬ জানুয়ারি থেকে ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামসহ আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কারাগারে আটক রয়েছেন। এরপরও গণমাধ্যমের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন, ধর্মীয় উগ্রপন্থী কর্তৃক মুক্ত চিন্তার লেখক ব্লগারদের হত্যার ঘটনা তো অহরহ ঘটেই চলেছে । এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩-এর ৫৭ ধারা সংশোধন এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪ তে বেশ কিছু ধারা সংযোজিত করেছে সরকার, যা গণমাধ্যম এবং ব্যক্তির স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
অথচ আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এই সমাজ বিবর্তনের ধারায় রয়েছে এই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরাট অবদান। আমরা কী আজ সাংবাদিকদের সেসব অবদানের কথা স্বীকার করছি? তাই আজ স্মরণে পরে প্রেসিডেন্ট জেফারসনের সেই কথা। তিনি রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবাদমাধ্যমের অসীম গুরুত্ব ও অপরিসীম ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‘যদি আমাকে বলা হয় কোনটা বেছে নেব সংবাদক্ষেত্র ছাড়া সরকার, না সরকার ছাড়া সংবাদক্ষেত্র? আমি বেছে নেব শেষেরটিকেই।” কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা যেন এই গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখেন। তাদের কথাবার্তা ও চালচলনেও সেটা ফুটে উঠে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।স্বাধীনতার পর জাতি পাকিস্তানীদের বঞ্চণা থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের প্রত্যাশা করেছিলো । কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর জাতির সেই প্রত্যাশা কী পূরণ হয়েছে? না, সেই প্রত্যাশা যেন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
তাই সবশেষে বলবো, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সুসংহত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে প্রথেমেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত কবরতে হবে। তবেই আশা করা যায়- দেরিতে হল্ওে একদিন জাতির সেই প্রত্যাশা গণতন্ত্রের পূরণ হবে। যেখানে নাগরিকরা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে তার মত ও চিন্তা চেতনা প্রকাশের সুযোগ পাবেন।
লেখক:
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
গবেষক ও কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]
মন্তব্য চালু নেই