কেউ কি দেখেছে এমন হন্তারক!

এমন কেউ কখনো দেখে নি, দেখবেও না হয়তো কোনো দিন! কিন্তু দিন শেষে এটা শুধুই তো একটা খেলা। কোচ স্কলারিকে মুখে বলার দরকার ছিলো না। কে না বুঝতে পারছে যে এটা তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন।

তারপরও ৭-১ ভুলেই তাকে নতুন একটা দিন শুরু করতে হবে। ম্যারাডোনা কি ভুলে যান নি! কিংবা আর্জেন্টিনা টিম অথবা আর্জেন্টিনা!

‘বলিভিয়ান প্রতিটি গোল আমার হৃদয়ে একটি করে ছুরিকাঘাত’ এমন বলেও তো ম্যারাডোনাকে ওই রক্তক্ষরণ ভুলতে হয়েছে। বেশিদিন আগের কথা তো আর না। মাত্র ৫ বছর।

২০০৯ সালের ১ এপ্রিল বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলো কোচ ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। খেলায় ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিলো তারা। শুনলে অবাক হবেন, মেক্সিকোর দ্বিতীয় বিভাগে খেলা এক স্ট্রাইকার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হ্যাটট্রিকও করেছিলেন।

৬-১ এ ওই ম্যাচ হারার পর ম্যারডোনা বলেছিলেন, এভরি বলিভিয়ান গোল ওয়াজ অ্যা স্ট্যাব ইন মাই হার্ট।

ফুটবলে এমন হয়। গতরাতে ৭-১ এ হারার আগেও ব্রাজিলের এরকম লজ্জার পরাজয় আছে। সেটা ১৯২০ সালে, উরুগুয়ের কাছে ৬-০ গোলে। সেটা তবু বিশ্বকাপ ছিলো না, কিন্তু বিশ্বকাপেই যে আর্জেন্টিনার এমন পরাজয়ের ইতিহাস। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে চেকোস্লাভাকিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হেরে গিয়েছিলো ‍আর্জেন্টিনা। এরপর ২০০৯ সালে বলিভিয়ার কাছে সেই লজ্জার হার। ফুটবলে এরকম হয়। জীবনে যেমন ব্যাখ্যার অতীত অনেক কিছু ঘটে, ফুটবলেও তাই।

কি ব্যাখ্যা আছে এই পরাজয়ের! নেইমার নেই, সিলভা নেই; এটা কোনো কারণ নয়। নেইমার-সিলভা না থাকাতে নার্ভাসনেস একটা সমস্যা ছিলো। কিন্তু এটাই সবকিছুর কারণ? ওদের ছাড়া কি এই ব্রাজিল দল ঘানা-যুক্তরাষ্ট্র-আলজেরিয়ার চেয়ে বেটার সাইড ছিলো না! তারপরও তো বিশাল পরাজয়ের লজ্জা, বেদনায় নীল!

আসলে কখনো কখনো এমন হয়ে যায় যে, আপনি যা চাচ্ছেন তার কোনো কিছুই হচ্ছে না, সবকিছুই প্রতিপক্ষের চাওয়ামতো। গতরাতের খেলায় মনে হচ্ছিলো, জার্মান দলকে গোল প্র্যাকটিস করাচ্ছেন জোয়াকিম লো। কোচ যেভাবে বলে দিয়েছেন, সবকিছু সেভাবেই করে একের পর এক গোল দিচ্ছেন ক্লোসা-মুলাররা। কোনো দলের পারকেশনের মাত্রা যখন একশতে একশ, তখন আপনার হতাশ চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

জার্মান দলও নিশ্চয়ই ভাবে নি, সবকিছু তাদের চাওয়ামতো এভাবে ঘটে যাবে, এরকমভাবে স্বপ্নপূরণ! জার্মানরা কাল যেভাবে খেলেছে কোনো মানবীয় দলের পক্ষে এমন খেলা ‘নেক্সট টু ইমপসিবল’। শুধু রোবটের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু তাই করে দেখিয়েছে জার্মান ব্রিগেড। তাই মাঠের অনেকটা জুড়ে থাকলেও ডি-বক্স আর গোলবারে ব্রাজিল ছিলো না। সেখানে যেনো কিছু পুতুল বসিয়ে জার্মানদের গোল প্র্যাকটিস।

তারপরও পিটার শিলটন মনে করছেন, ম্যাচে ব্রাজিলের ফিরে আসার যে সামান্য সুযোগ ছিলো সেটা বানচাল করে দিয়েছেন নয়্যারের অতিমানবীয় গোলকিপিং। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গোলকিপার শিলটনকে গতরাতের ‘হার্ডেস্ট কোয়েশ্চেন’ হিসেবে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, এ রাতের বেস্ট দিক কোনটি?
শিলটন বললেন, নয়্যার। ব্রাজিলিয়ানরা যে কতোবার ম্যাচে ফিরে ‍আসার চেষ্টা করেছে, ততোবারই তা ধ্বংস করে দিয়েছেন নয়্যার।

সত্যিই তাই। প্রতিপক্ষ যখন মেশিনের পারফেকশনে যেভাবে চায় সেভাবেই গোল করে আর আপনি মিনিমাম চান্সও পান না, তখন রেজাল্টটা ৭-১ই হতে পারে।

তবে জার্মানরাও যে শেষ পর্যন্ত মানুষ, যন্ত্র না; তাও তো দেখলাম খেলা শেষে। ব্রাজিলকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলেও তাদের শরীরী ভাষায় অহমিকা ছিলো না। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিল ফুটবলের সবচেয়ে থারাপ দিন নিশ্চিত করে ওই দিনটিতে আবার তারাই সান্ত্বনা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। খেলা শেষে ডেভিড লুইজের প্রার্থনার সময় জার্মানরা যে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, এটা ছিলো অসাধারণ এক দৃশ্য।

প্রার্থনায় লুইজ হয় তো ঈশ্বরের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি চেয়েছেন। জার্মানদের কাছে এভাবে খুন হয়ে সেই শক্তি ফিরে পাওয়াটা এখন খুব জরুরি।

হয় তো নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপে চরম লজ্জআর পরাজয় নিশ্চিত করে ব্রাজিলিয়ানদের সবচেয়ে নির্মম উপহারটাই দিয়েছেন ফুটবল ঈশ্বর। কিন্তু তিনিও জানেন, এখানেই সব শেষ হয়ে যায় নি, ধ্বংস হয়ে যায় নি ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবল।



মন্তব্য চালু নেই