কূটনীতিকদের সহায়তায় সক্রিয় উত্তর কোরীয় অপরাধীরা

উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের কূটনীতিক পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ একটি চক্র বাংলাদেশে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সোনা চোরাচালান এবং অবৈধ মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র রয়েছে। এ অপরাধীচক্রের ‘আখড়ায়’ পরিণত হয়েছে রাজধানীর বনানীর পিয়ংইয়ং রেস্টুরেন্টটি। গত বৃহস্পতিবার রাতে এ রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানোর পর এমনই তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিপুল পরিমাণ মদ, ভায়াগ্রাসহ গ্রেপ্তার করা উত্তর কোরিয়ান নারী রায়াগ সুন হায়াকে আদালতের নির্দেশে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবারের ওই অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাধা দেন উত্তর কোরিয়ার কাউন্সিলর মিং আনসহ দূতাবাসের ৯ কর্মকর্তা। গত ৭ মার্চ বিমানবন্দরে ২৭ কেজি চোরাই সোনাসহ আটকের পর তৎকালীন উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট সেক্রেটারি সন ইয়াম ন্যামকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এই কূটনৈতিকের বিরুদ্ধেও নিয়ম অমান্য করে অকূটনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। পাশাপাশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে মাদক-বাণিজ্য, সোনা চোরাচালানসহ অপরাধে জড়িতদের চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে তদন্তকারীরা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান গতকাল বলেন, ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করায় উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের ওই কাউন্সিলরসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পিয়ংইয়ং রেস্টুরেন্টে অবৈধ বার ও উত্তেজক ওষুধের বাণিজ্য চলছিল। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের অনুমোদন ও নির্দেশনায় সেখানে অভিযান চালানো হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকালই মিং আনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এনবিআর থেকে ওই চিঠি আজকালের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে পারে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মিং আনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযানে বাধা দেন। তাঁরা শুল্ক গোয়েন্দাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তবে নিজেদের পরিচয় বিস্তারিত জানাননি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড একজন কূটনৈতিকের অপরাধ। সূত্র জানায়, বিদেশি কোনো নাগরিক ঝামেলায় পড়লে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ‘কনস্যুলার সার্ভিস’ চাইতে পারে। যে দেশে ঝামেলায় পড়বে সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই সাহায্য চেয়ে আবেদন করা হয়। অবৈধ কাজে জড়ালে ওই নাগরিকের সাহায্যে দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তা সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারেন না।

গত বৃহস্পতিবার রাতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ডিবি পুলিশের সহায়তা নিয়ে বনানীর ২৭ নম্বর সড়কের ১৫ নম্বর বাড়িতে পিয়ংইয়ং রেস্টুরেন্টে অভিযান চালান। এ সময় উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের কাউন্সিলর মিং আনসহ ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে উপস্থিত হয়ে অভিযানে বাধা দেন। তাঁদের চাপ উপেক্ষা করে রেস্টুরেন্টে তল্লাশি চালিয়ে ৯৪ ক্যান ফস্টার বিয়ার, ১০ বোতল হুইস্কি ও ২১০ পিস ভায়াগ্রাসহ বিপুল পরিমাণ ক্যাপসুল জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অবৈধ বারের মালিক উত্তর কোরীয় নাগরিক রায়াগ সুন হায়াকে। এ ঘটনায় বনানী থানায় কাস্টমস অ্যাক্ট, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে রায়াগ সুন হায়াকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) মোর্শেদ আলম বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে রায়াগ সুন হায়া দীর্ঘদিন পিয়ংইয়ংয়ে অবৈধভাবে বার চালানোর কথা স্বীকার করেন। তাঁর আরো কয়েকজন অংশীদার রয়েছেন। তাঁদের আটকের চেষ্টা চলছে।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পর্দার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরেই পিয়ংইয়ং রেস্টুরেন্ট উত্তর কোরিয়াকেন্দ্রিক অপরাধীচক্রের ‘সেফ হাউস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। অপরাধীচক্রের সঙ্গে বাংলাদেশি কয়েকজন অসৎ ব্যক্তির যোগসূত্র পেয়েছে গোয়েন্দারা। গত ৭ মার্চ বিমানবন্দরে ২৭ কেজি সোনাসহ তৎকালীন উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট সেক্রেটারি সন ইয়াম ন্যামকে আটকের পরই দূতাবাস-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তৎপরতার ওপর নজরদারি শুরু করে গোয়েন্দারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ বারে মদ ও যৌন উত্তেজক ওষুধের বাণিজ্য ধরা পড়ে। রায়াগ সুন হায়া ১৮ জন নারীকে সঙ্গে নিয়ে ওই বারটি চালাতেন। বৃহস্পতিবার অভিযানের সময় ওই নারীরা অভিযান পরিচালনাকারীদের ওপর চড়াও হয়। পরে পুলিশ দিয়ে সেখানে তল্লাশি করা হয়। জানা গেছে, গতকালও পিয়ংইয়ং রেস্টুরেন্টে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়ো হন। স্বল্প পরিসরে রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও বার ছিল পুরোপুরি বন্ধ।



মন্তব্য চালু নেই