কারণ ছাড়াই বাড়ছে চিনি ও ছোলার দাম

পাইকারি বাজারে গত বৃহস্পতিবার থেকে হঠাৎ করেই চিনির দাম কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেড়ে যায়। অথচ বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়েনি, দেশেও কোনো ঘাটতি তৈরি হয়নি। ব্যবসায়ীদের দাবি, বেসরকারি চিনি কারখানা থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পাওয়ায় দাম বেড়েছে। খবর-প্রথম আলো

যাঁরা অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেন, তাঁদের সবারই কারখানা রয়েছে। দেশে চিনির প্রধান আমদানিকারক সিটি গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানের চিনির কারখানায় গত বৃহস্পতিবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এরপর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে বেড়ে যায় চিনির দাম। এর প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারেও।

চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে মোট আমদানি হওয়া অপরিশোধিত চিনি ৪০ শতাংশই এনেছে সিটি গ্রুপ। দেশে চিনি আমদানি করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। অথচ আট বছর আগেও ৮২টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি আমদানি করত।

গতকাল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৬০ থেকে ৬১ টাকায় বিক্রি হয়।

চিনির মতো ছোলার বাজারেও একই অবস্থা। গত বছরের মে মাসে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকায়। তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় এবার আগের দামে ছোলা কেনা যাবে না, এটি প্রায় নিশ্চিত। তবে বিশ্ববাজার থেকে কেনা ছোলা খুচরা বাজারে প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারক থেকে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত তিন স্তরে প্রতিকেজি ছোলায় দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। যেমন মিয়ানমারের ছোলার আমদানি মূল্য টনে ৯০০ ডলার (কেজিতে ৭২ টাকা), ভোক্তারা হাতে পৌঁছানোর পর এর দাম পড়ছে ১ হাজার ২৫০ ডলার (কেজিতে ১০০ টাকা)।

গত এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ছোলা আমদানি হয় ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ৬৮ টাকায়। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। বন্দর থেকে ছোলা খালাসসহ আনুষঙ্গিক খরচ পড়ে কেজিতে তিন টাকা।

ছোলার বাজার অস্থির হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে আমদানিকারকের সংখ্যা কমে যাওয়া। গত অর্থবছরও ৯৮টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল ছোলা আমদানিতে। এ বছর আমদানিকারকের সংখ্যা নেমে এসেছে ৫৬ জনে। আমদানিকারকের সংখ্যা কমার পাশাপাশি আমদানিও কমেছে ছোলার। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে প্রতিযোগিতা কমতে থাকায় এভাবে হঠাৎ করেই কোনো না কোনো পণ্যের দাম কারণ ছাড়াই বেড়ে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আমদানিকারকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই সাতটি পণ্য সব সময় প্রতিযোগিতামূলক দামে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার চলে গেছে। এ কারণে উৎসব বা নানা উপলক্ষে বাড়তি চাহিদা তৈরি হলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্য ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন হয়। এখনো সেই আইন বাস্তবায়িত হয়নি। আইনটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ইচ্ছামতো দাম কমিয়ে মাঝারি পুঁজির শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বাজার থেকে হটিয়ে দেওয়া কিংবা রাতারাতি দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকত না। ভোক্তারাও সুরক্ষা পেত।

অবশ্য মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় এগিয়ে আসায় বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকছে। অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কোন প্রতিষ্ঠান কোন পণ্য কত দরে আমদানি করছে, তা এখন সবাই জানতে পারে। তিনি বলেন, উৎপাদন বন্ধের গুজবের কারণেই চিনির দাম বেড়েছে। পরিশোধন কারখানার মালিকেরা চিনির দাম বাড়াননি।

আমদানিকারকের সংখ্যা কমলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই বলে মন্তব্য করেন শীর্ষ আমদানিকারক সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিত সাহা। তিনি বলেন, আমদানিকারকের সংখ্যা কমলেও পণ্য আমদানি কমেনি। ফলে দাম নিয়ে শঙ্কা থাকার কথা নয়। তাঁদের কারখানায় উৎপাদন সাময়িক ব্যাঘাত হলেও চিনির সরবরাহ বন্ধ করা হয়নি।
চিনির মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিশ্বজিত সাহা বলেন, কেউ হয়তো সাময়িক সুযোগ নিয়েছে। তবে দু-এক দিনের মধ্যে তাঁরা পুরোদমে চিনি সরবরাহ শুরু করতে পারলে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ থাকবে না।

পরিশোধন কারখানা চালুর পর চিনির বাজার কারখানার মালিকদের হাতে চলে যায়। কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, এ অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি হওয়া ১৭ লাখ ৮০ হাজার টন চিনির মধ্যে সিটি, মেঘনা ও এস আলম এনেছে ৮১ শতাংশ। আট বছর আগেও পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত চিনি আমদানি করত ৮২টি প্রতিষ্ঠান।

ডাল: এক বছর আগে ডাল আমদানি করত ১০৭টি প্রতিষ্ঠান। এ বছর আমদানি করে ৮৯টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানই ৮৩ শতাংশ আমদানি করে। এ অর্থবছরের ১০ মাসে ৬ লাখ ২০ হাজার টন ছোলা, মটর ও মসুর ডাল আমদানি হয়। মোট আমদানির ৫১ শতাংশই বিএসএম, সিটি গ্রুপ এবং স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের। তবে রোজা সামনে এলেও ডালের দাম এখনো স্থিতিশীল রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই