কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে?
[ নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের সমসাময়িক বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেন নিয়মিত। গত ১১ তারিখে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ উপলক্ষে তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে যে কথাগুলো লিখেন আওয়ার নিউজের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল। ]
৪৪ বছর অনেকগুলো বছর। এতগুলো বছরে একাত্তরের বাংলাদেশ-বিরোধী ইসলামি-মৌলবাদী শক্তি দেশটাকে প্রায় পুরোটাই নষ্ট করে ফেলেছে। ওই অপশক্তিকে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা গর্তে লুকিয়েছিল, আজ তারা দেশের বিশাল এক রাজনৈতিক শক্তি, তাদের তৈরি ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সৈনিকে দেশ আজ টইটম্বুর। এই দেশটাকে শুদ্ধ করতে আরও কত ৪৪ বছরের দরকার হবে কে জানে।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি হওয়ার পর বাংলাদেশের কি কোনও পরিবর্তন হবে? জামাতির সন্ত্রাস বন্ধ হবে? শিবিরের হত্যাকান্ড থামবে? হুমায়ুন আজাদরা আক্রান্ত হবেন না? অভিজিৎরা আর খুন হবেন না? ওয়াশিকুরদের কেউ মারবে না? এর উত্তরে যে কেউ বলবে, হত্যাকান্ড চলতেই থাকবে। আমিও জানি চলতেই থাকবে।
অনেকে ভুল করে, ক্ষমা চায়, নিজেকে শোধরায়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কামারুজ্জামান কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন? যদি একবারও ভাবতেন যে তিনি একাত্তরে অন্যায় করেছিলেন, তবে তিনি আর যাই করতেন, জামাতে ইসলামির মতো একটা সন্ত্রাসী দলের নেতা হতেন না। বাংলাদেশের যে ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন সন্ত্রাস দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে। আমার মনে হয় রাগটা যত না ৪৪ বছর আগের সন্ত্রাসের জন্য, তার চেয়ে বেশি এখনকার সন্ত্রাসের জন্য, কামরুজ্জামানের শিষ্যরা যে সন্ত্রাস বুক ফুলিয়ে করছে। আর মানুষ বাধ্য হচ্ছে ঘোর অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করতে। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ধর্মমুক্ত মানুষদের অনেক বছর যাবৎ ঠান্ডা মাথায় হত্যা করছে। সন্ত্রাস- বিরোধী-শক্তি যেহেতু হাতে চাপাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না, তারা রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে দু’একটা মৃত্যুদন্ড ঘটায়।
যথেষ্ট খুনোখুনি হলো। বাংলাদেশের মানুষ এবার পেছনে কবে কী করেছিলো ভুলে এখন কে কী করছে সেটা দেখুক। এখন থেকে যেন জামাতিরা কোনও সন্ত্রাস, কোনও রগ কাটা, গলা কাটা, বোমা ছোড়া–কিছুই করতে না পারে। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, মাদ্রাসা মসজিদের আতংকবাদী রাজনীতি আর অশ্লীল ওয়াজ মাহফিলগুলো বন্ধ না করলে শুধু কামারুজ্জামানদের মেরে কোনও ফল পাওয়া যাবে না।
দেশটাকে ভালো করতে হলে দেশটার গলায় ছাগলের দড়ি বেঁধে ছেড়ে দিলে হয় না। দেশটাকে দেখে দেখে রাখতে হয়। দেশটার পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। দেশ বলতে তো মানুষ। মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। মানুষের জন্য সুশিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যর ব্যবস্থা করতে হয়। দারিদ্র ঘোচাতে হয়, জীবন যাপনের মান বাড়াতে হয়। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাস থেকে মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হয়। দূর্নীতিমুক্ত সমাজ তৈরি করতে হয়। অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হয়। ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি—এসব যেহেতু সমাজের ধ্বংস ডেকে আনে, এগুলো থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হয়। শেখাতে হয় ধর্ম মানে হিজাব বোরখা টুপি জোব্বা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে মসজিদ মাদ্রাসা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে পাঁচবেলা নামাজ আর একমাস রোজা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে অন্য ধর্মকে ঘৃণা করা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে ধর্মে-অবিশ্বাসীদের হত্যা করা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। আর সব কিছুর মতো ধর্মেরও বিবর্তন ঘটে। ১৪০০ বছর ধরে ইসলাম যদি এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে এ নিশ্চয়ই বিষম দুশ্চিন্তার বিষয়। ধর্মের বিবর্তন আপনাআপনি হয় না, এটিকে হওয়াতে হয়। হওয়ায় ওই ধর্ম যারা পালন করে, তারা। ইসলামের বিবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধুরন্দর মুসলিমরা, যারা এই ধর্মকে অবিবর্তিত অপরিবর্তিত অবস্থায় রেখে দিতে চায় এটি নিয়ে ব্যবসা করার জন্য, এটির অপব্যবহার করার জন্য, এটি নিয়ে সন্ত্রাস করার জন্য, এটিকে রাজনীতি ব্যবহার করার জন্য। এরাই এই ধর্মের মূল শত্রু। এদের কারণে ইসলাম একটি ‘অমানবিক ধর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। খ্রিস্টান ধর্ম বা ইহুদি ধর্ম কম অমানবিক নয়, কিন্তু বিবর্তিত হয়েছে বলে আজ এই ধর্মগুলোকে মানবিক বলে মনে হয়। ইসলামের পরিবর্তন ছাড়া এখন আর উপায় নেই। হয় তলিয়ে যাও ধর্মান্ধতায়, নয় উঠে দাঁড়াও, শক্ত হাতে হাল ধরো, সমাজকে শুদ্ধ করো, রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করো। ধর্ম দিয়ে যে যুগে রাষ্ট্র চালানো হতো– সে যুগকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। মানুষকে এখন যে কোনও একটি বেছে নিতে হবে– অন্ধকার যুগের দিকে ফিরে যাওয়া, অথবা সামনে সম্ভাবনা বা আলোর দিকে যাওয়া।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে? কামারুজ্জামান ছিলেন ৬২ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। তিনি যৌবনেই যত অপকর্ম আছে করে ফেলেছেন। তাঁকে চার দশকের চেয়েও বেশি সময় দেওয়া হয়েছে অপকর্ম করার জন্য। তিনি একাত্তরে যত অন্যায় করেছেন, যত ক্ষতি করেছেন দেশের, তার চেয়েও বেশি করেছেন একাত্তরের পরে। তিনি দেশের নিরীহ ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই করেছেন ইসলাম দিয়ে, আর বিশাল এক ধর্মান্ধ খুনীবাহিনী তৈরি করেছেন। তাঁর খুনীবাহিনীই আজ লেখক অভিজিৎ রায়কে খুন করে, তাঁর খুনীবাহিনীই আজ ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে খুন করে। এক কামারুজ্জামান মরে গেছেন, লক্ষ কামারুজ্জামান আজ বাংলার ঘরে ঘরে। খুব সাবধান বাংলাদেশ, বাঁচতে চাও তো চাপাতি ছুড়ে ফেলো, ফাঁসির দড়ি ছিড়ে ফেলো, শুভবুদ্ধি জাগাও সবার মধ্যে।
সূত্র: ফেসবুক স্ট্যাটাস
মন্তব্য চালু নেই