কান পেতে শুনুন রেহানেহ জাবারির কান্না
‘দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতেই তো আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোণে। কয়েক দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়তো না, কারণ আমাদের না আছে র্অথ, না ক্ষমতা’
এমনই মর্মস্পর্শী ভাষায় মায়ের কাছে জীবনের শেষ চিঠি রেখে গেছেন রেহানেহ জাবারি। হতভাগ্য মানবজাতিকে দিয়ে গেছেন ব্যর্থতার দায়ভার। নারী সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে কট্টর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয় নির্মমতার আঁচলে। তবুও অন্যায়ের নিকট মাথা ঝুঁকেনি তার, ফাঁসির আদেশ শুনেও বুক কাঁপেনি এতটুকু। একফোটা জলও গড়িয়ে পড়েনি নয়ন কোণে। বীর দর্পে গ্রহণ করে নিয়েছেন মৃত্যুকে। আসলে তার ফাঁসি হয়নি, ফাঁসি হয়েছে সেই সকল আগ্রাসী মানব চরিত্রের যাদের মানস পর্দায় নারী কেবলই ভোগ বস্তু।
গত ২৫ অক্টোবর ২০১৪ শনিবার ভোরে ফাঁসি হয় ২৬ বছর বয়সী রেহানেহ জাবারির। অভিযোগ ২০০৭ সালে ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন, যখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর। ইরানের আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার নেতা-কর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামকে উপেক্ষা করে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নিভিয়ে দেয়া হয় তার জীবনদীপ।
রেহানেহ হৃদয় বিদারক সেই চিঠিতে আরো লিখে গেছেন, ‘আদালতে আমায় এক ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু‘ আমি চোখের পানি ফেলিনি। ভিক্ষাও করিনি। আমি কাঁদিনি কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল। কিন্তু বিচারে বলা হলো, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ। আচ্ছা মা, আমি তো কোনোদিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড ধরে জানালার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমিই নাকি মাথা খাটিয়ে মানুষ খুন করেছি! উল্টো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের ওপর কী সুন্দর নেল পলিশের জল্লো ছিল। হাতের তালু কত নরম তুলতুলে। সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড়। তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হলো।’
রেহানেহর দাবী, তাকে ধর্ষণের লোলুপ হাত নিয়ে এসেছিল হায়েনারা। আর তাই আত্মসম্ভ্রম রক্ষার্থেই ছুরি হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। নিজেকে রাঙিয়ে ছিলেন মানুষ রূপী পশুর রক্তে। নারী সমাজের সম্মুখে সাহসের প্রতীক মূর্তির মালা না পরিয়ে, ঠান্ডা মাথার খুনি প্রমাণ করে ফাঁস মঞ্চের দড়িই হলো তার যুদ্ধের পুরস্কার। ইরান সরকারের এমন অভিনব সিদ্ধান্তে বিমূঢ় পুরো দেশ, পুরো বিশ্ব। তবে কি এই মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশটি প্রমাণ করে দিল যে নারী জাতি অসহায়! পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যে, নিজের সম্ভ্রম রক্ষার্থে দেয়ালে যখন নারীদের পিঠ ঠেকে যায় তখন তারা বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার গ্লানিকেই সম্বল করে বিদায় নেয়। রেখে যায় ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা। আমাদের দেশের বুশরা, সামিয়া, বীণাসহ আরো অনেকেই তারই দৈন্য উদাহরণ। কিন্তু চিন্তা করে উত্তর মেলেনা যদি বলি, আত্মহত্যা নাকি মহাপাপ। আর তা এমনই পাপ যা নাকি ক্ষমার অযোগ্য। অপর দিকে বলা হয় পরপুরুষের সাথে কথা বলাতো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকানোও নাকি হারাম। আবার এদিকে হাফেজ মৌলবীদের কন্ঠে শুনতে পাই ভিন্ন সুর। ধর্ষিতাও নাকি সমান অপরাধি! তাকে দোররা মারা, পাথর মারা, জীবন্ত পুঁতে ফেলার কাহিনীও আমরা দেখতে পাই কালে কালে যুগে যুগে। ধর্মের এই কঠিন গুরপাক-লঘুপাকে নারীজাতি কেবল ঘুরতেই থাকে। আসলে আমাদের এই সমাজ-ব্যবস্থা ও সংকীর্ণ মানসিকতাই বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, নারীরা অবলা। অতএব ঘরের চারদেয়ালটাই কেবল তাদের পৃথিবী, দেশ, সমাজ। এর বাহিরে যেন তাদের কিছু ভাবাই অন্যায়। ধর্ম নিয়ে কোন ভ্রুলেশ নেই আমার কেননা, আমি মনে করি নীতিবোধের অপর নামই ধর্ম, এটি বিশ্বাস ও অবগাহনের বিষয়। কিন্তু মানুষের বিবেক? তাকেও কি দিতে হচ্ছে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে কবর ! তাই যদি না হয় তবে শুধু মেয়েরাই কেন বন্দী থাকবে, শুধু মেয়েরাই কেন পুরুষ সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়াবে ; কেন পুরুষেরা জাগ্রত চিত্তে নিজেদের পরিবর্তনের জন্য শপথ নেয়না। প্রকৃত অর্থে পুরুষ যদি নিজেকে আত্মশুদ্ধির কাঠকয়লায় পোড়ায় কেবল তখনই এই পৃথিবী হবে শান্তিময়।
নির্মম যন্ত্রণায় পুড়তে পুড়তে রেহানেহ জাবারি মায়ের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও। এই পৃথবিী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি আমি সুখী হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরসিমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তবে সৃষ্টির্কতার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙুল তুলব সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে, আর তাদের দিকে যারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়।’
একজন মানুষ কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে এভাবে নিভৃত কন্ঠে অভয় দিতে পারে তার মাকে। হাসতে হাসতে ছেড়ে যায় পৃথিবীর মায়া। ভাবতে কষ্ট লাগে যে, আমার বয়সী কোন মেয়েও যে এভাবে বীর দর্পে সাতটি বছর কাটিয়ে দিতে পারে অন্ধকার জেলগারে। তার অপরাধ এটাই ছিল যে ন্যায়ের জন্য লড়াই করেছিল, কিন্তু অস্ত্র-সাজের সেই হীন সামরিকের দুই বুটের মাঝবরাবর পরাস্ত্র হয়নি। তোমাকে বাঁচাতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত বোন রেহানেহ জাবারি, ব্যর্থ পুরো পৃথিবী। তবে তোমার সেই দীপ্ত গর্জনের সাহসে সাহসী হয়ে পুরো নারী জাতিকে বলতে চাই- আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে গর্জে যাবো, প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যাবো। এতে মূলত হার হবে সেই কলংকিত পৃথিবীর,আর আমরা থাকবো অপাজেয়, হাসবো শুভ্র হাসি. . .
শান্তা ফারজানা : সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি)
মন্তব্য চালু নেই