কাজ নেই তবুও সব সুবিধাই নিচ্ছেন তিনি

সরকারের অংশ হয়েও সরকারের সমালোচনা করছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মন্ত্রিসভা থেকে তার দলের সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়ে বলছেন প্রায়ই। কিন্তু সরকারি দায়িত্ব কবে ছাড়বেন বা আদৌ ছাড়বেন কি না, সে বিষয়ে একেবারে চুপ তিনি।

৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭ দিনের মাথায় ১২ জানুয়ারি শপথ নেয় নতুন মন্ত্রিসভা। সেদিনই মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান এরশাদ। কথা ছিল, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আর জনশক্তি রপ্তানিতে গতি আনতে কাজ করবেন তিনি। কিন্তু প্রায় এক বছর হতে চলল, বিশেষ দূত হিসেবে কিছুই করেননি এরশাদ। তিনি কী করতে চান, তার দায়িত্বের বিস্তারিত কী হবে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়নি সরকার বা এরশাদের দপ্তর থেকে। বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে জাতীয় পার্টির নেতারাও।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন এরশাদ। নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়া, বিএনপি না এলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া, পরেই আবার মত পাল্টে সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়া, নির্বাচনকালীন সরকার থেকে দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের ঘোষণা, তারপরও কারও দায়িত্ব পালন করে যাওয়া, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, কারও প্রত্যাহার, এরশাদের মনোনয়নপত্রও প্রত্যাহার একটি আসন থেকে, আবার সময়মতো এবং ঠিকঠাকভাবে আবেদন না করায় দুটি আসনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন নাকচ হওয়া, রংপুরে একটি আসন থেকে নির্বাচিত হওয়া, সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া, পরে আলাদা শপথের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন এরশাদ ও তার দলের নেতারা।

ভোটের আগ থেকে শুরু করে সরকারের শপথ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই এরশাদ ছিলেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার কী রোগ ছিল তা জানা যায়নি কখনো। কখনো এরশাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, জোর করে তাকে হাসপাতালে ধরে রাখা হয়েছে, কখনো স্ত্রী রওশন জানিয়েছেন, এরশাদের সম্মতিতেই নির্বাচনে যাচ্ছেন তিনি।
নানা নাটকীয়তার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে একেবারেই চুপ এরশাদ। কেবল একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তার কী দায়িত্ব সে নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। এরপর আর কোনো কাজই দৃশ্যমান নয়। কাজ না থাকলেও একজন পূর্ণমন্ত্রীর বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন এরশাদ। নিয়মিত বেতনও তুলছেন।

সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে এরশাদের মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ১০০ টাকা, যা সম্পূর্ণ করমুক্ত। জাতীয় সংসদ ভবনে একটি কার্যালয়ও পেয়েছেন তিনি। বিশেষ দূত হিসেবে বসানো হয়েছে তার নামফলকও। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা, একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিব এবং দুজন অফিস স্টাফসহ পাচ্ছেন নিরাপত্তা সুবিধা, পুলিশ প্রটোকল। চড়ছেন সরকারি পাজেরো গাড়িতে। আর গাড়িতে ব্যবহার করছেন জাতীয় পতাকা। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণ, ভ্রমণের জন্য বিশেষ ভাতা, ইনস্যুরেন্স, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা, দেশ-বিদেশে যোগাযোগের জন্য তার বাসা ও অফিসের টিঅ্যান্ডটি ফোন এবং হাতে রাখা মোবাইল ফোনের বিল এসব কিছুই চলছে সরকারি খরচে। সব কিছু মিলিয়ে তার পেছনে প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।

কাজ না করে কেন এরশাদ টাকা নিচ্ছেন, এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন না। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় বলেন, ‘মন্ত্রণালয় স্যারকে কাজ দিক বা না দিক সেটা তাদের ব্যাপার। তবে যেহেতু তাকে একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই তার পারিশ্রমিকও দেওয়া হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধাই তিনি পাচ্ছেন।’ এরশাদের বেতন তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সুনীল শুভ রায় বলেন, ‘তিনি প্রয়োজনমতো অবশ্যই বেতন তুলবেন।’

তার কাজ কী জানায়নি সরকারও
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রে বলা হয়ে থাকে তার কী কী কাজ থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নিয়মকানুন নেই। যাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তিনি বলতে পারবেন তার কী কাজ।
এরশাদ দায়িত্ব পাওয়ার ৫৩ দিন পর ৫ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন বিশেষ দূত হিসেবে তার দায়িত্ব কি জানতে। সেখানে তিনি কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির বিষয়েও দুজনের মধ্যে কথা হয়। কিন্তু সে সময় তাকে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
বলা হচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে সরকারের দূত হিসেবে এরশাদ সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করবেন। কিন্তু এ পর্যন্ত এমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। দায়িত্ব পাওয়ার পর কয়েক মাস আগে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন মাত্র। ব্যক্তিগত সফরে একবার ভারতও গেছেন। দলের প্রধান হিসেবে যাবেন চীনে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরশাদের ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, ‘স্যারের (এরশাদ) বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তার গেজেটে বিশেষ কোনো কাজ করার কথা উল্লেখ নেই। তবে শুনেছি, যেহেতু তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক ভালো। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও জনশক্তি বিষয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বা সম্পর্কের ঘাটতি রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে তিনি সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করবেন।’

ওই নেতা বলেন, ‘স্যার নিজের তাগিদেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানিসহ দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চান। কিন্তু ওই দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূলত তার কোনো কাজই নেই।’
তবে এ কথা মানতে নারাজ দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তার মতে, ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে এরই মধ্যে এরশাদ দৃশ্যমান কাজ করতে শুরু করছেন। আর সব কাজই দৃশ্যমান হতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। এছাড়া জাতীয় পার্টি সরকারের আমলে এরশাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এখনও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে। আমাদের চেয়ারম্যানকে কাজে লাগাতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আবার খুলবে।’

১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এরশাদ। গণআন্দোলনে তার পতনের পর পাঁচ বছরের বেশি সময় জেল খাটেন তিনি। তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পর তার সমর্থনেই সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধেন এরশাদ। নির্বাচনের আগেই আবার জোট ছাড়েন তিনি। এ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে দেখা দেয় ভাঙন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে নির্বাচন করে এরশাদের জাতীয় পার্টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এই জোট ভাঙে। বিএনপি-জামায়াত জোট এবং আরও বেশ কয়টি রাজনৈতিক দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সুযোগে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল এখন জাতীয় পার্টি। তবে দলের প্রধান হয়েও বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেননি এরশাদ। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদে তাদের নেতা নির্বাচন করেছেন রওশনকে।
নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে র‌্যাব-পুলিশের একটি দল এরশাদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালÑসিএমএইচে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে দেয়। যদিও এরশাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল তিনি সুস্থ, তাকে চিকিৎসা নয়, আটক করা হয়েছে।

এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেছেন কি করেননি, সে প্রশ্নের সুরাহা হয়নি এখনও। দলের একাংশের নেতারা নির্বাচন বর্জনের কথা জানালেও অপর অংশ জানিয়েছে, নির্বাচনে আগ্রহী এরশাদ। পরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ৪০ জন নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য হিসেবে। এই সদস্যদের সঙ্গে শপথ নেননি এরশাদ। রংপুর-৩ আসনের সদস্য হিসেবে অন্য নেতাদের দুদিন পর একা শপথ নেন তিনি। ১২ জানুয়ারি নতুন সরকারের শপথের রাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগের কথা জানানো হয়। এর আগে এমন বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. ফারুক সোবহান।
এরশাদের কাজ কী, সে বিষয়ে আওয়ামী লীগেরও আছে বিভ্রান্তি। আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, ‘আসলে এরশাদকে কোথাও পাঠানো হবে না। একটি পদ তাকে দেওয়া হয়েছে সম্মান করে।’ তবে আরেক নেতা বলেছেন, ‘শিগগিরই মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে পাঠানো হতে পারে এরশাদকে।’
কবে নাগাদ এরশাদ সরকারি দায়িত্ব পালনে বিদেশ যাবেনÑ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘প্রয়োজন হলেই তিনি সফর করবেন। তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। আমরা তাকে তথ্য দিচ্ছি। আবার বিশেষ দূত হিসেবে সফর নির্ভর করে রাষ্ট্রগুলো কখন আমন্ত্রণ জানায় তার ওপর।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।



মন্তব্য চালু নেই