বিটিসিএলে জনবল কাঠামোয় অস্বচ্ছতা

কাজ না করেও মজুরি নেন অধিকাংশ অস্থায়ী কর্মচারী

রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অস্থায়ী জনবল নিয়োগে সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই। নিয়মিত জনবলের ঘাটতি মেটাতে প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি কর্মচারী। তাদের অর্ধেকের বেশি কাজ না করেই মজুরি তুলছেন নিয়মিত। বিটিসিএলের একশ্রেণীর কর্মকর্তার সহায়তায় বছরের পর বছর চলছে এ অনিয়ম।

বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, তিন ধরনের অস্থায়ী কর্মচারী কাজ করছেন সংস্থাটিতে— ওয়ার্ক চার্জড, ক্যাজুয়াল ও মাস্টাররোল। এটি কোম্পানিতে পরিণত করার শর্ত হিসেবে ২০০৫ সালে মাস্টাররোল কর্মচারীদের ওয়ার্ক চার্জড হিসেবে পদায়ন করা হয়। ওই সময় এ ধরনের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৭৮। এর মধ্যে বর্তমানে কর্মরত প্রায় ২ হাজার ৬০০ জন। তবে এসব কর্মচারীর অর্ধেকের বেশি নিয়মিত অফিস না করলেও প্রদেয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিভাগীয় কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে জানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না।

জানা গেছে, মগবাজার বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ওয়ার্ক চার্জড হিসেবে কর্মরত ক্যাশিয়ার কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেই মাসের পর মাস নিয়মিত বেতন নিয়েছেন। বিটিসিএলের অভ্যন্তরীণ তদন্তে এর সত্যতা বেরিয়ে আসে। পরে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।

সারা দেশে বিটিসিএলের ৭৭৬টি অফিস রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে এসব অফিসে নিয়মিত ভিত্তিতে মাস্টাররোল ও ক্যাজুয়াল শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। মাস্টাররোল পদে রয়েছেন ১ হাজার ৮৫৭ কর্মচারী। এ পদে দৈনিক ভিত্তিতে একজন কর্মচারীকে ৩০৩ টাকা হারে মজুরি দেয়া হয়। এর বাইরে প্রতিদিন ৮০০-এর বেশি ক্যাজুয়াল শ্রমিক প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত কাজ করেন। এসব ক্যাজুয়াল শ্রমিক প্রতিদিন ২৫০ টাকা হারে ভাতা পান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিটিসিএলে অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে মাস্টাররোল শ্রমিক কল্যাণ সমিতি। এ সমিতির আবার দুটি গ্রুপ রয়েছে। এ দুই গ্রুপের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের যোগসাজশে শ্রমিক নিয়োগ না দিয়েই প্রতিদিনের মজুরি তুলে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ভুয়া লোকবল দেখানোর পাশাপাশি ভুয়া স্বাক্ষরও নেয়া হয়।

সূত্র জানায়, পরিচালক রাজস্ব ১ ও ২-এর আওতাধীন বিভিন্ন অফিসে রাজস্ব আহরণে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। এসব কর্মচারী রাজস্ব আহরণ করে তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় আত্মসাৎ করেন।

রাজস্ব আহরণে বিটিসিএলের নিয়মিত জনবলের অভাবে এ দায়িত্ব পালন করা হয় ওয়ার্ক চার্জড কর্মচারী, মাস্টাররোল ও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের দিয়ে। নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনিয়মের মাধ্যমে এদের দিয়েই আর্থিক লেনদেন করেন। তাদের সহায়তা নিয়েই সরিয়ে ফেলা হয় সব নথি। এ কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে যায় সবাই। এসব অনিয়মিত কর্মচারীদের অবৈধ লেনদেন সম্পর্কে জানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

অস্থায়ী জনবল কাঠামো বিষয়ে বিটিসিএলের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত পরিচালিত হয়। তদন্ত দলের সদস্য বিটিসিএলের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ (নিরাপত্তা) আ আ মো. মুয়াসির জানান, বিটিসিএলের ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশন্স (ডিওটি) গঠনের অংশ হিসেবে ওয়ার্ক চার্জড কর্মচারীদের কোন পদে কীভাবে আত্তীকরণ করা যায়, সে বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। তবে অন্য অস্থায়ী লোকবল সম্পর্কে আমার জানা নেই।

বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে অনুমোদিত জনবল কাঠামো ১৯ হাজার ৬৬ জনের। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৭ হাজার ৩২৫ জন। ২০১২-১৩ অর্থবছর ৫৪৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে কোম্পানিটিকে। গত অর্থবছরও বিটিসিএলের লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫৪৬ কোটি টাকা। ১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যয় হয় ১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা।

বিটিসিএলের সদস্য (অর্থ) ড. মো. আবু সাইদ খান জানান, কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকেই নতুন নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের দিয়ে বাধ্য হয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। তবে অনিয়মের সঙ্গে যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাত্ক্ষণিক বদলি, চাকরিচ্যুতিসহ বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই