কাউন্সিলে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে বিএনপিতে

প্রায় ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ষষ্ঠ কাউন্সিলে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে বিএনপিতে। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটি ঢেলে সাজানোর পর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও আপাদমস্তক পরিবর্তনের আওতায় আসছে।

ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে দলকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত দিতে ‘যোগ্য নেতা’ সৃষ্টিতে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন খালেদা জিয়া। সেজন্য এবারের কাউন্সিলের পর নির্বাহী কমিটিতে দেখা যাবে যোগ্য, তরুণ এবং দলের জন্য নিবেদিতদের। এক্ষেত্রে সাইট বেঞ্চে চলে যেতে পারেন দলের প্রভাবশালী, অথচ বিতর্কিত অনেক নেতা। দলের দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বেশ কয়েকবার ষষ্ঠ কাউন্সিলের অগ্রগতিতে স্থবিরতা নেমে আসলেও এবার আগামী মার্চেই কাউন্সিল করবে বিএনপি। শনিবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নীতিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত তারিখ নির্দিষ্ট না হলেও মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। যদিও বিষয়টি নির্ভর করতে ভেন্যু পাওয়া নিয়ে।

সূত্র জানায়, কাউন্সিলের জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রকে প্রথম স্থান হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। কোনো কারণে সেটা না পেলে বিকল্প হিসেবে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে কাউন্সিলের স্থান হিসেবে ধরা হয়েছে।

এর আগে ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের জন্য ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রধান করে সমন্বয় কমিটি গঠন ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতাদের প্রধান করে ১২টি উপকমিটি গঠন করা হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে খসড়া সাব-কমিটির একটি বৈঠকও হয়। তারপর থেমে যায় সে প্রক্রিয়া। দুই বছর ধরে কয়েকবার কাউন্সিলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় বিএনপি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এখন দলটির জেলা পর্যায়ের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। গত বছরের ৯ আগস্ট বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি জেলা নেতাদের পাঠানো হয়েছে। এতে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর দুই দফা সময় বাড়ানো হলেও জেলা কমিটির নেতারা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে পারেননি। পরে পৌর নির্বাচন শুরু হওয়ায় জেলা কমিটিগুলোর কাজ স্থগিত হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠকের পর জেলা কমিটির পুনর্গঠনের কাজ আবারও জোরেশোরে শুরু হয়।

শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়া কাউন্সিলের আগে দ্রুত তৃণমূলের কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এই ব্যাপারে তৃণমূলকে আর কোনো সময় দেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়। জেলা কমিটিগুলোর পুনর্গঠনের পরপরই মার্চে ষষ্ঠ কাউন্সিল করবে বিএনপি।

দলের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে বিএনপিতে। দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিবসহ নির্বাহী কমিটির প্রতিটি জায়গায় বাদ যাচ্ছেন নিষ্ক্রিয়রা। এদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অপক্ষোকৃত তরুণ, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য ও মেধাবী নেতারা। এ লক্ষ্যে বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারমান তারেক রহমানের আলোচনা হয়েছে। বিএনপির দুই দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন, তাদের কালো তালিকাও করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে বেশ কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কয়েকজন নিষ্ক্রিয়। মারা গেছেন তিন জন। তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এছাড়া বাকি নেতাদেরও কেউ কেউ বয়সের কারণে ন্যূজ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থতার কারণে এম শামসুল ইসলাম এবং বেগম সারোয়ারি রহমান- এই দুজন আর এ কমিটিতে থাকবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এসব পদ পূরণের ক্ষেত্রে তিনজন নতুন মুখ ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত করেছেন খালেদা জিয়া। বাকি তিন থেকে চারটি পদে নতুন মুখ আনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। স্থায়ী কমিটি থেকে যারা সরে যাবেন কিংবা বাদ পড়বেন তাদের একই সমমর্যাদায় গঠিত দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হবে। এদিকে এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়েই এবার ভারমুক্ত হবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কার্যনির্বাহী কমিটি এবার সম্পূর্ণ ওলট-পালট হচ্ছে। নির্বাহী কমিটির আকারও ছোট হচ্ছে। কাউন্সিলে অনেক বড় বড় নেতাও ছিটকে পড়তে পারেন নির্বাহী কমিটি থেকে।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, মির্জা ফখরুলকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হলে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নাম মোটামুটি নিশ্চিত। এছাড়া কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম-মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হবে। ছাত্রদলের প্রাক্তন নেতাদের নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর চিন্তাভাবনা চলছে।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দল পুনর্গঠন করে বিএনপি। ২০০৯ সালের জুন মাসে একসঙ্গে ৭২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। ওই বছর ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল। পরের বছর জানুয়ারিতে গঠন করা হয় ৩৮৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় নির্বাহী কমিটি। তিন বছর মেয়াদি কমিটির সময় আড়াই বছর আগেই শেষ হয়েছে। এর আগে দুই দফা কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, কাউন্সিলকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। আশা করছি, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হবে এবারের কাউন্সিলে।

দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর কাউন্সিল হওয়ায় এ নিয়ে নেতাকর্মীদের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে আরো যোগাযোগ বাড়বে, তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

তিনি আরো জানান, কাউন্সিলে নেতৃত্বে অনেক পরিবর্তন আসবে। যোগ্য, মেধাবী ও দলের জন্য নিবেদিতরা দায়িত্বশীল জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হবেন। সর্বোপরি কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন এক বিএনপিকেই দেখা।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর প্রথম কাউন্সিল হয়। দ্বিতীয় কাউন্সিল হয় ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর এর আট বছর পর ১৯৮৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দলটির তৃতীয় কাউন্সিল। ১৯৯৩ সালের ১, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি চতুর্থ কাউন্সিল করে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর হয় পঞ্চম কাউন্সিল।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই