কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষামন্ত্রী

আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রশ্ন ফাঁসকারীদের উদ্দেশে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। সেই সাথে প্রশ্নফাঁসকারীদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান বলেছেন, ‘আমি এই সমস্ত কাজে যারা জড়িত তাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলতে চাই, যদি এবার সাহস থাকে তবে আমাদের মোকাবিলা করুক।’

‘আশ্বস্ত করতে পারি এবার যেই হোক এই সুষ্ঠু পরীক্ষার কাজে যারা বাধা দেবে প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কোনো অবস্থাতেই প্রশ্ন ফাঁস বা এ ধরনের গুজব কিংবা পরীক্ষা কেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্ন করে এ ধরনের সাহস কেউ দেখাবে না।’

আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্পর্কিত জাতীয় মনিটরিং কমিটির দ্বিতীয় সভা শেষে গত ১৩ জানুয়ারি মারুফ হাসান এ কথা বলেন।

অন্যদিকে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সরকারের তৎপরতা শতভাগ ঢেলে সাজানো হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, কেউ অপরাধ করে আর পার পাবে না। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে ফেসবুকে কেউ বিভ্রান্তি ছড়ালে বিটিআরসি সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ করে দেবে।

এছাড়া প্রশ্ন ফাঁসে সন্দেহের এক নম্বর তালিকায় থাকা বিজি প্রেসের সংশ্লিষ্টদের পুরো তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, এবার প্রেসের (বিজি প্রেস) প্রতি বেশি জোর দিচ্ছি। যারা ভাল কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের অপবাদ দিচ্ছি না। সেখানে যারা দুষ্টু লোক তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি, এবার কোনভাবেই রেহাই পাবেন না। তারা শুধু না, তাদের বংশধর কারা কোথায় আছেন, তাদেরও মনিটরিংয়ের মধ্যে রেখেছি। তারা বাবা-মা, ভাই-ফ্রেন্ড কার সঙ্গে বেশি আড্ডা দেন, প্রেমিক-প্রেমিকা কেউই বাদ নেই, সবাইকে মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা হয়েছে। বিজি প্রেস এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ফাঁসের গুজব ছড়ানো, ফেসবুকে প্রশ্নপত্রের নামে হুজুগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পাবলিক পরীক্ষা আইন-১৯৮০(সংশোধিত ১৯৯৮)-এর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।

তবে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের হুঁশিয়ারি বাক্যালাপ নতুন কিছু নয়, ইতোপূর্বেও আমরা এর চেয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি শুনে এসেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাধি পাবলিক পরীক্ষা থেকে সব ধরনের পরীক্ষায় ছড়িয়েছে। এ থেকে রেহাই পায়নি আমাদের শিশুরাও।

এরপর আবার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে এবার ব্যবস্থাপনায় পুলিশকে অধিকতর সম্পৃক্ত করায় এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা উৎকণ্ঠাও রয়েছে। কারণ ইতোপূর্বে বারবার দুর্নীতিতে শীর্ষে থেকেছে এই সংস্থাটি। ফলে তারা পাবলিক পরীক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তা দেখতে আমাদের কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা সফল হোক এটাই সবার প্রত্যাশা। তবে এবার যে শিক্ষামন্ত্রী আরো বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে শিক্ষায় অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতিসহ নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর এসব অপরাধ রোধে দেশের প্রচলিত আইনে তেমন কার্যকর সুরক্ষা নেই। শিক্ষা সেক্টরে বড় ধরনের অপরাধ করেও প্রচলিত আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধী চক্র। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষায় অপরাধ প্রবণতা রোধে যুগোপযোগী ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকেই সর্বমহলেই অনুভূত হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষা কর্মকর্তা ও অন্য সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন, শিক্ষায় গতিশীলতা সৃষ্টি করতে শিক্ষা আইন প্রণয়ন এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

প্রসঙ্গত, মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর গত কয়েক বছরে প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একাধিকবার ফাঁস হয়। সর্বশেষ গেল বছরে উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে দেশজুড়ে ব্যাপক হৈ-চৈ হয়। প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল পত্রিকায় একাধিক কলাম লেখেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে দাবি করেন। শিক্ষামন্ত্রী পত্রিকায় কলাম লেখেও জবাব দেন। পরে প্রশ্ন ফাঁস রোধে করণীয় নিয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে (জুলাই) মন্ত্রণালয়ে সভা করেন। সভার পরামর্শের আলোকেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ব্যাপারে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে দ্য পাবলিক একজামিনেশন্স (অফেন্সেস অ্যাক্ট-১৯৮০, সংশোধিত ১৯৯২) শীর্ষক এই আইন মূলত দেশের পাবলিক পরীক্ষার পরিচালনা, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে থাকে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আইনটি সুরক্ষা দিতে পারছে না আমাদের শিক্ষাকে।

যে কোনো কোনো নীতি বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রয়োজন। তাই জাতীয় সংসদ কর্তৃক জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ গৃহীত হওয়ার দীর্ঘ দুই বছর পর ২০১৩ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় শিক্ষমন্ত্রণালয়। সেই আলোকে মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের পর ২০১৩ সালে পরে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে খসড়া আইনটির ওপর সর্বস্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। যত দূর জানা যায়, তাতে খসড়া আইনটির ওপর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৪টি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৯৪টি ও বিশিষ্ট নাগরিকসহ ব্যক্তি পর্যায়ে ১০৬টিসহ মোট ২৩৪টি মতামত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৫টি পূর্ণাঙ্গ মতামত। এই খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষে সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট কর্মশালা অনুষ্ঠিত। এ মতামতের ভিত্তিতেই জাতীয় সংসদে এ আইনটি উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও আইনটি মন্ত্রিসভায়ই চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

এর আগে প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা আইন-২০১৩’ এর বিরোধিতায় মাঠে নামে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী দেশের সব শিক্ষক সংগঠনগুলো। খসড়া আইনে সংযোজিত ‘শিক্ষকদের শাস্তির বিধান ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধের ধারা বাতিল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেয়ার বিধানও বাতিলের দাবি করেন তারা।

এরপর ২০১৪ সালে আবারও আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। ২৮ আগস্ট ‘প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৪’ এর খসড়া পর্যালোচনায় ২০১৪ সালের শিক্ষা আইনের ৬৪ নম্বর ধারায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের কথা বলা হয়। খসড়া আইনে ৬৭টি ধারা এবং ২৮০টি উপধারা রয়েছে।

পর্যালোচনায় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক, উপানুষ্ঠানিক বয়স্ক ও জীবনব্যাপী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মোট চার স্তর বিশিষ্ট শিক্ষা আইন ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ৬৭টি ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ‘সহায়ক পুস্তক’ প্রকাশের সুযোগ দিয়ে এবং মেডিকেল কলেজের ন্যায় সরকারি-বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা চালুর বিধান রেখে ‘শিক্ষা আইন-২০১৪’ এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খসড়া আইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানেরও বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িত, ভুয়া সনদে চাকরি এবং সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারির বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) এবং প্রতিষ্ঠানের এমপিও সাময়িক বন্ধ, আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্তন কিংবা বাতিলেরও বিধান রাখা হয়েছে খসড়া শিক্ষা আইনে।

এ বিষয়ে শিক্ষাসচিবের বক্তব্য হলো, শিক্ষা আইন চূড়ান্তকরণে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মন্ত্রিসভায়ও উত্থাপন করা হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকতর গতিশীল, ডিজিটাল ও দুর্নীতিমুক্ত করতে এই আইন জুরুরি প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।

সবশেষে বলতে চাই, সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা? নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা আইন, ২০১৪ খসড়াটি পরিমার্জন করে দ্রুত চূড়ান্ত রূপ দেয়া হোক। শিক্ষানীতি, ২০১০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত মানোন্নয়নের জন্যই শিক্ষা আইন হওয়া অত্যাবশ্যক। সেই সাথে প্রত্যাশা করবো- এবার সব ধরনের কলঙ্কমুক্ত একটি পাবলিক পরীক্ষা উপহার দিতে সক্ষম হবেন আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক।
ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই