ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আদ্যোপান্ত

মামলাটির প্রকৃত শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। কিন্তু শিরোনাম যা-ই থাক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বা ‘আগরতলা মামলা’। শেষোক্ত নামগুলোর আড়ালে চাপা পড়ে যায় মামলাটির প্রকৃত নাম। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা এই মামলা সম্পর্কে এর আগে আমরা কয়েকটি স্মৃতিকথা ও গবেষণামূলক বই পেয়েছি। সে বিচারে কর্নেল শওকত আলীর সত্য মামলা আগরতলা এই বিষয়ক আরেকটি বই, যার পাঠের ভেতর দিয়ে আমরা জানতে পারব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে বাঙালিবিদ্বেষী পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ সংঘটনের লক্ষ্যে কী ধরনের প্রয়াস চালানো হয়েছিল, তার প্রায় আদ্যোপান্ত বিবরণ।

লেখক তাঁর ভূমিকা মারফত জানাচ্ছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যাঁরা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, “ষড়যন্ত্র” শব্দটি তাঁদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব।’

মোট নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি যখন পাঠ করি, আক্রান্ত হই রোমাঞ্চের পর রোমাঞ্চে। বইয়ে লেখকের জীবনের যে ধারাক্রম সংবলিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন লেখককে ছুঁয়ে যাচ্ছে, মনে রেখাপাত করছে তার ঘটনাধারা, কলেজজীবনে ওঠার পরপরই তাঁকে আলোড়িত করছে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি—যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। এবং লেখকের বয়ান সূত্রেই আমরা জানতে পারছি, পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরা কোন দৃষ্টিতে দেখতেন বাঙালি সেনাদের। বিদ্রোহ শূন্য থেকে দানা বাঁধেনি। শওকত আলীর জবানিতেই এ-সংক্রান্ত বিবরণ, ‘বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণ সম্পর্কে আমি ধীরে ধীরে জানতে শুরু করেছিলাম। আমি ধীরে ধীরে আরও উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম যে বাঙালি সৈনিকেরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে প্রচণ্ডভাবে আগ্রহী।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে, বিশেষত তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সৈনিকেরা পশ্চিমাদের কোন চোখে দেখত এবং তারা কী পরিমাণ ঘৃণা ও বৈষম্যের শিকার ছিল, তা জানতে হলে এ বইয়ের ‘পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালির অবস্থান’ শিরোনামের অধ্যায়টির পাঠ অত্যন্ত জরুরি।

১৯৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণার পর রাজনৈতিক ঘটনা যত তুঙ্গে উঠছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতরেও পড়েছে তার প্রভাব। শওকত আলী জানাচ্ছেন, ‘লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সঙ্গে প্রথম বৈঠকটি খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তখন থেকেই শুরু। সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৬৬ সালের জুন মাস। আনুষ্ঠানিক এবং বিশদ আলোচনা ছাড়াই আমরা একমত হয়েছিলাম যে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গঠিত “বিপ্লবী সংস্থার” সদস্য।’

সেনাবাহিনীর ভেতরে ওই সময় বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যদের তৎপরতা কত বিচিত্রভাবে চলেছিল, তার বিবরণ ধরা আছে ‘বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি’ অধ্যায়ে। এমনকি পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দারা কীভাবে তাদের অনুসরণ করছে, প্রখরভাবে নজর রাখছে, তা-ও আছে এখানে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিকল্পনা যে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না তাঁরা, এ অধ্যায়ে আছে তারও প্রায় অনুপুঙ্খ বিবরণ।

সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার কত রকমের প্রয়াস যে চলেছে, ক্রমেই তার ইতিহাস বা বিবরণ জানার আওতায় আসছে আমাদের। সর্বশেষ আমরা পেলাম সত্য মামলা আগরতলা। বইটিতে যেমন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিকদের বিপ্লবী প্রয়াসের কথা রয়েছে, তেমনি আছে তাঁদের নির্যাতিত হওয়া, বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও মুক্তি পাওয়ার প্রসঙ্গও।



মন্তব্য চালু নেই