এতো সস্তা কেন এদেশের মানুষের জীবন?

ইশরাত জাহান ঊর্মি : ঈদের আগে লিখেছিলাম স্বপ্ন যাবে বাড়ি বলে ফোন কোম্পানির আবেগ বেচা বিজ্ঞাপনের কথা। কীভাবে, কোন স্বপ্ন চোখে নিয়ে এদেশের আম পাবলিক গ্রামের বাড়ি যায় সেই কথা লিখতে লিখতে নিজের মনেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। বেশিদিন লাগেনি। ঈদের আগেই ট্যাম্পাকো কারখানায় পুড়ে জ্বলে গেল কতগুলো প্রাণ। আসলে কি প্রাণ? উন্নয়নের হাতিয়ার মাত্র। এদের দিয়েই উন্নয়ন হয়। একসেট পুড়ে গেলে আরেক সেট পাওয়া যায়। কোনো অসুবিধা হয় না।

তারপর সড়ক দুর্ঘটনা। ঈদের আগে-পড়ে আমাদের সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী নায়োকচিতভাবে হাঁটেন। না, তার হাঁটা নিয়ে আমার অন্তত কোনো আপত্তি নেই। মন্ত্রী আসছেন শুনলে যেখানে খুব বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকে সেখানেও কিছুক্ষণের জন্য হয়তো শৃঙ্খলা ফিরে আসে। মন্ত্রী হামলে পড়া টেলিভিশনের ক্যামেরায় টেনে টেনে বলেন, ‘এ-খ-ন-ও কিছু সমস্যা আছে। তবে আমরা সব সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছি।’

এবং সেইসব চেষ্টাকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে সাত থেকে পনেরো তারিখ পর্যন্ত ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আবার পড়ুন ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনা। মারা গেছেন ১৫৭ জন, আহত হয়েছেন ৩৬৫ জন।

তারপর পোস্তায় সেদিন রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা লিক করে এক পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ। চিকিৎসক ভদ্রলোক অমলিন গলায় কার শরীরের কত অংশ পুড়েছে তা বর্ণণা করছিলেন। আমি নিউজ পড়ছিলাম। দুই আড়াই বছরের একটা বাচ্চার ব্যান্ডেজ বাঁধা পুরো শরীর দেখে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যেন স্বাভাবিকভাবে পরের নিউজটা পড়তে পারি, সিএনএন এর প্রেজেন্টারদের (ওমরান এর ছবি দেখে কেঁদে টিআরপি বাড়িয়েছিলেন কেট বলজোয়ান) মতো নাটক করার পারমিশন আমাদের নেই। আগুনে ঝলসানো দুই বছরের বাচ্চার ছবি দেখতে দেখতে স্বাভাবিকভাবে আমাদের পরের নিউজটা পড়তে হয় যেটা হয়তো উন্নয়ন বা জিডিপি গ্রোথের কোনো সংবাদ!

খুব মনে আছে খিলক্ষেত বা নিকুঞ্জের ঘটনা। পরিবারের কর্তা থাকেন কাতারে। সকালবেলা নাস্তা বানাচ্ছেন কর্ত্রী আর গৃহকর্মী। গ্যাসের লাইন লিক ছিল, আগুন ধরে বাড়ির বড় মেয়ে দুই ছেলেসহ মা আর গৃহকর্মী দগ্ধ। কাভার করতে গিয়েছিলাম। বড় মেয়েটার চেহারা এখনো চোখে ভাসে। ছিপছিপে, টানটান। বলছিল, সংসারটা ছাড়খাড় হবে। আব্বার আসার কথা আগামী মাসে। আম্মা অপেক্ষা করছিল…

দুদিন পরে ফলোআপে জেনেছিলাম গৃহকর্মী আর মা-টি মরে গেছেন। জীবনের কী সস্তা অপচয়!

এই কথাটাই শুধু মনে হয় আমার, এদেশের মানুষের জীবনের দাম এতো এতো সস্তা কেন? এতো সহজে গাড়ি খালে পড়ে, দু’গাড়ির অকারণ সংঘর্ষে, গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে, বজ্রপাতে, চুলার আগুনে এদেশের মানুষ প্রতিদিন মরে কেন? তাহলে এই যে জিডিপি গ্রোথ আর এতো এতো উন্নয়ন এগুলো কোথায়, কাদের জন্য লাগে?

এবং এই ঘটনাগুলো বারেবারেই ঘটে। এই যে ঈদের সময় মানুষের ভোগান্তি। উৎসব না কি আতংক এদেশের মানুষের কাছে তা আমি এখন আর পরিষ্কার বুঝি না। টেলিভিশনের রিপোর্টাররা পিস টু ক্যামেরায় বলেন, ‘যতই ভোগান্তি হোক, মানুষ যখন প্রিয়জনের সাথে মেলে তখন ভুলে যায় সব।’

আসলেই কি সব ভুলে যায় মানুষ? এদেশের সর্বংসহা আর রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ না করা মানুষেরা বুঝি অনেকটা কেঁচোর মতো। তাদের মৃত্যুতে তাই বিশেষ কিছু আসে-যায় না। জীবন হাতে নিয়েই তারা উৎসব করতে নামে।

আর এইযে ট্যাম্পাকো বা চুলার আগুন। এ শহরটা পুরোটা শহর তো হয়ে উঠলো না, এক অদ্ভুত বর্বর অসভ্য একটা জনপদ হয়ে রইরো। এ শহরের যানজটের জন্য হারিয়ে যায় মানুষের সুকুমার বৃত্তি, মানুষের সাথে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে নানান বিকৃতি ঢুকে পড়ে সম্পর্কের খাঁজেখোঁজে। যার জন্য দায়ী আসলেই এই শহরটা।

আগুনে পুড়লে প্রশাসন বলে, এইগুলো দুর্ঘটনা। বাড়ির চুলা তো মাসে মাসে চেক করানোর কথা, কোথাও কোনো সমস্যা আছে কি না, করেন না কেন? দোষটা কি আমাদের?

এইটা যে একটা টোটাল প্রাকটিসের ব্যাপার। নাগরিক কিছু পরিচর্যার বিষয় এগুলো সেটা তারা বলেন না। নদীভাঙা আর গ্রামে কাজ না পাওয়া মানুষ এসে যখন ভিড় জমান শহরে, বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় একটা ছেলে বা মেয়েকে দাঁতে দাঁত চেপে মেস বা পায়রার খোপের মতো বিভিন্ন বাড়িঘরে থাকতে হয় বছরের পর বছর, শীতে-গ্রীষ্মে-বর্ষায়, এই জীবন, এই শহুরে অসভ্য জীবন যে তারা নিজের ইচ্ছায় বেছে নেননি তা আমাদের প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্র বলে না।

এবং শেষপর্যন্ত খুব আলগোছে একটা চুলার আগুন লিক হয়ে বা সশব্দে দুই বাসের সংঘর্ষে মরবে মানুষ, আমরা এটাকে দুর্ঘটনা বলবো। এভাবে চলতেই থাকবে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজ



মন্তব্য চালু নেই