এক মামলায় ৪৩ বছর কাটলো ফসর আলীর
শরিফুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: গায়ে আকাশী রঙের পাঞ্জাবি। পায়ে কোনো জুতা নেই। পায়ের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তিনি পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এরপর দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন পড়ছেন তিনি। তবে মনে হলো তিনি চোখে কম দেখেন। কারণ কাগজটি চোখের খুব কাছাকাছি এনে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তারপরও কাগজের কোনো লেখা মনে হয় স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন না। এরপর তিনি আমাকে ডাকলেন লেখাটা পড়ে দেয়ার জন্য। তার অাহ্বানে সাড়া দিলাম। দেখলাম ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার বরাবর একটি অভিযোগপত্র। পুলিশ সুপার লেখাটিই তিনি স্পষ্টবুঝতে পারছিলেন না। সেটা বলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে কাগজটি নিয়ে নিলেন তিনি। অার এ কারণেই ঘটনাটি জানার আগ্রহ বেড়ে গেল আমার। চাচা কিসের অভিযোগ এটি জানতে চাওয়া মাত্রই তিনি বললেন, কেন অাপনি কি মেম্বার। মাথা নাড়িয়ে অাশ্বস্ত করার পর গড়গড় করে বলা শুরু করলেন তার জীবনের করুণ কাহিনী।
আজ দুপুরে ঠাকুরগাঁও অাদালত চত্বরে কথা হয় তার সঙ্গে। নাম তার ফসর অালী। বাড়ি সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের পোকাতি গ্রামে। ৭০ বছর বয়সী এই মানুষটি যে দীর্ঘদিন ধরে অাদালত পাড়ায় হয়রানি হয়ে ঘুরছেন প্রমাণ পেলাম তার অাইনি অভিজ্ঞতা দেখে। জেলার অধিকাংশ অাইনজীবীর নাম তার ঠোটে লেগে রয়েছে।
অালাপকালে ফসর আলী জানান, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রতিবেশি মফিজ মেম্বার তাকে একটি হত্যা মামলার অাসামি করে ঠাকুরগাঁও অাদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর শুরু হয় পুলিশি হয়রানি। এভাবে ৮ বছর চলার পর ১৯৮১ সালের জুন মাসে তিনি ওই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান। তবে এর মাঝে তার জীবনের সঞ্চয় ১০ বিঘা জমি এবং তিন সন্তানকে হারিয়েছেন তিনি। এখন ফসর আলী অাদালতে ছোটাছুটি করছেন ওই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তার যেসব সম্পদ এবং টাকা খরচ হয়েছে সেগুলো ফিরে পেতে। ফসর অালী কেঁদে দিয়ে বললেন মামলা চালাতে গিয়ে অামার পরনের লুঙ্গিটিও বিক্রি করে দিয়েছিলাম। তখন ৬ জনের সংসারে কি যে অভাব গেছে বলে বোঝাতে পারবো না। তবে এখন তিন বেলা খেতে পারেন ভালোভাবে।
ফসর অালীর বাড়ি থেকে ঠাকুরগাঁও অাদালত চত্ত্বরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। অার এই রাস্তা তিনি হেঁটে যাওয়া অাসা করেন। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিতে তিনি সপ্তাহে তিনদিন অাদালতে যান। তার সঙ্গে কথা শেষ করেই কথা হলো অাদালতে হাজিরা দিতে অাসা এক নারীর সঙ্গে।
জমি সংক্রান্ত মামলায় দীর্ঘ ৮ বছর ধরে সদর উপজেলার বড়গাঁও থেকে এসে হাজিরা দেন তিনি। তাসলিমা নামের এই নারী জানালেন, অামাদের এলাকার অনেক লোক ফকির হয়ে গেছে মামলা চালাতে গিয়ে। আর এসব মামলা চলে বহুদিন। শুধু ফসর অালী অার তাসলিমাই না। মামলার পেছনে ছুটতে গিয়ে তাদের মতো শত শত মানুষের দিন কাটছে অাদালত পাড়ায়।
মন্তব্য চালু নেই