এক ‘অনন্য নারী’ বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারের স্ত্রী!

পরিবারের অমতে ভালবেসে বিয়ে করেছি। অনেকে বাধা দিয়েছে, এরকম ছেলেকে বিয়ে করো না,কিন্তু আমি শুনিনি। তাকেই বিয়ে করেছি। আমি তাকে ভালবাসি। মা-বাবা হয়তো আরেক জায়গায় বিয়ে দিতো। কপাল মন্দ হলে সেখান থেকেও তো ফেরত আসতে হতো। আর তার এই অসুখ যদি বিয়ের পরে হতো, তাহলে কী তাকে ফালায়ে যেতে পারতাম আমি। মানুষটাতো অনেক ভালো,প্রথমে তাকে দেখে মায়া লাগছে,পরে ধীরে ধীরে ভালবেসেছি। মানুষের বাড়িতে পানি দেই,কাঁথা সেলাই করে উপার্জন করি যতোটুকু পারি। আধপেট খাই, কতোদিন না খাইয়া থাকছি,কিন্তু ছাইড়্যা যাই নাই।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটের বারান্দায় বসে কথাগুলো বলছিলেন হালিমা খাতুন। আর হালিমা যাকে পরম মমতায় ভালবেসে বিয়ে করেছেন তিনি আবুল বাজানদার। দুই হাত এবং দুই পায়ে গাছের শিকড়ের মতো জট গজানোয় যিনি ইতোমধ্যেই উপাধি পেয়েছেন ‘বৃক্ষমানব’ নামে।

বিয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হালিমা বলেন, উনি দু’হাতে কিছু করতে পারেন না, তার জন্য এমন একজন লোক দরকার যে তার ব্যক্তিগত কাজগুলো করে দিতে পারে, এই ভাবনা থেকেই তার সঙ্গী হয়েছি। তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সেখানে তাকে দেখি, তখন এক-আধটু কথা হতো, পরে তার বাড়িতে চলে এসেছি। বিয়েতে আমার মা রাজি ছিলেন না। তাই মায়ের অমতে পালিয়ে এসে তাকে বিয়ে করেছি। বিয়ের পরেও মা আমাদের মেনে নেননি। ২০১৩ সালে মেয়ের জন্মের পরে মার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এখন মা বেড়াতে আসেন, আমিও যাই।

নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে হালিমা জানান, ভালো ছাত্রী ছিলাম, চুনকুড়ি গ্রামের শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এ-মাইনাস পেয়ে চালনা মহিলা কলেজে ভর্তিও হয়েছিলাম। তিনমাস ক্লাস করেছি, তারপরই আবুলের পরিবারে চলে আসি। হালিমা বলেন, লেখাপড়ায় অনেক আগ্রহ ছিল আমার। কিন্তু গরীব ঘরে জন্ম। এজন্য আমার স্যারেরা অনেক সাহায্য করেছেন। লালউদ্দিন স্যার,তাপসী ম্যাডাম, ঠাকুর দাস স্যার আমাকে কেরোসিন তেল কিনে দিয়েছেন, বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে স্কুলে যেতাম বলে স্যাররা ছাতা কিনে দিয়েছেন,পোশাক দিয়েছেন,বীজ গণিত কম বুঝতাম,ক্লাস টেনের টেস্টের পর সমীরণ স্যার নিজে তিনমাস বিনা পয়সায় অংক করাইছেন-বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন হালিমা। বলেন,বই-খাতা কেনার সামর্থ্য ছিল না,স্কুলের পরীক্ষার খাতার যেসব সাদা পাতা থেকে যেত স্যাররা সেগুলো আমাকে দিতেন,আমি সেগুলো সেলাই করে খাতা বানিয়ে লিখতাম।

আবুল মানুষ হিসেবে কেমন জানতে চাইলে মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে দিয়ে লজ্জাবনত মুখে হালিমা জানান, খুবই ভালো মানুষ। আর কথা কাটাকাটি, রাগারাগি তো সব সংসারেই হয়ে থাকে, দু’টো মানুষ একসঙ্গে থাকলে মতের অমিল হবেই, আর মানুষটা হাতে পায়ে পাথরসমান বোঝা নিয়ে ১০ বছর ধরে অসুস্থ, প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁদতো,তখন ভালো কথাও সহজভাবে নিতো না,এতে আমি তার দোষ দেইনা।এমন কষ্ট যার হয় সে-ই কেবল বোঝে, তার কেমন লাগে। কখনও চিন্তা করিনি যে, তার হাত আবার সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পাবে। তবে এজন্য চেষ্টা করেছি অনেক।

আবুল বাজানদারের হাত পায়ে শিকড়ের মতো গজানো এই বিরল রোগে মানুষ যতোটা না বিস্ময় প্রকাশ করেছে, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে আবুল বিবাহিত, এ কথা শুনে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেরই একজন চিকিৎসক নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মানুষ হিসেবে আমরা খুবই বিচিত্র আবুল বাজানদারকে এ অবস্থায় কেউ বিয়ে করতে পারে এটা এখনও অনেকের কাছেই বিস্ময়। অথচ ২০১১ সালে আবুল বাজানদারকে ভালবেসে নিজের ঘর ছাড়েন হালিমা। গত ১০ বছর ধরে আবুল এই রোগে আক্রান্ত।

বিরল রোগ ‘ইপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভ্যারুসিফরমিসে আক্রান্ত হয়ে আবুল বাজানদার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন গত ৩০ জানুয়ারি। গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার ডান হাতের অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং তিনি বর্তমানে সুস্থ আছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

অপারেশনের পরে ভালো লাগছে, উনি এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। আমার চেয়ে খুশি আর কে হতে পারে-কথাগুলো যখন হালিমা বলছিলেন তখন তার চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছিল।তবে এটা বোধহয় কষ্টের কান্না নয়, ‘আনন্দঅশ্রু’।

-বাংলা ট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই