একজন সাংবাদিকের ‘সুইসাইড’ নোট

দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার ঠাকুরগাঁওয়ের স্টাফ রিপোর্টার আলী আহসান হাবিব আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি তারআগে ফেসবুকে তার কারণ উল্লেখ্য করে একটি হৃদয়স্পর্শী স্ট্যাটাস দেন। সেটা হুবহু পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

একটি আগাম মৃত্যু সংবাদ: জীবনের শেষ মুহূর্তে সকল ফেসবুক বন্ধুদের বলছি, আজ আমার জীবনের শেষ রাত। তাই আমার এ শেষ লেখাটা পড়ুন। আর সকল সচেতন বন্ধুদের কাছে অবিচারের ফিরিস্তি দিলাম। জানি আপনারা কেউ বিচার করতে পারবেন না, তারপরেও জানাচ্ছি একারণে যে সাংবাদিকরা মানবতার কথা বলে, তাদের মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণের কথা কেউ জানতে পারেন না। মিডিয়ার ভেতরে ঢুকে আছে কিছু মুখোশধারী, আর তাদের মুখোশ খুলে দিয়ে আজ রাতেই চির বিদায় নিবো। কারণ অপমান সইবার ক্ষমতা সবার থাকে না। আর আমার সততার পুরস্কার হিসেবে ‘কালের কণ্ঠ’ আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যা নিজেকেই কার্যকর করতে হবে।

জন্ম নেবার পরে কখনো ভাবিনাই সাংবাদিক হবো। কিন্তু মানুষের ভালোবাসার টানে হতে হয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিবিদ, পুলিশ, জঙ্গি সবার মারপিটের চিহ্ন আমাকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। প্রথম আলো ছেড়ে তৌহিদ ভাইয়ের হাত ধরে কালের কণ্ঠে এলাম, কয়েকটা টাকা বেশি পাবো বলে। প্রথম আলোতে কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক ঋণ হয়ে যায়। কালের কণ্ঠের অভ্যন্তরীণ দলাদলির বলী হলাম আমি। নীতির সঙ্গে আপোষ করতে না পারায় গত ২ বছর আগে কালের কণ্ঠের মফস্বল সম্পাদক শামীম সাহেব আমার বেতন বন্ধ করে দেন। অথচ আমাকে স্টাফ রিপোর্টারের পদবীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যেখানে মফস্বল সম্পাদকের কোনো নিয়ন্ত্রণ স্টাফ রিপোর্টারের ওপর থাকে না।

ঢাকা অফিসে গেলাম। একজন দেখায় ওকে আরেকজন দেখায় অন্যকে। সেখানকার হিসাবরক্ষকের কাছে বিষয়টিতে কী করণীয় জানতে গেলে তিনি আমাকে বলেন, ‘যান শামীম সাহেবের হাত-পা ধরে বসে থাকেন।’ আমি চমকে উঠলাম যে একজন কেরাণীও প্রভুর মতো আচরণ করছেন। শামীম সাহেবের কাছে সেদিন অসংখ্যবার গেলাম। একাউন্টস থেকে বলা হলো, ‘শামীম সাহেব মৌখিকভাবে বলে আমার বেতন বন্ধ করেছেন। শামীম সাহেব লিখিত দিলে তা পুনরায় চালু হবে।’

আমি হতাশ, কারণ যখন সাংবাদিকতায় আসি, তখন আমার ওপর পারিবারিক কোনো দায়িত্ব ছিল না। আর এখন আমাকে আমার জন্ম দেয়া মেয়ের দায়িত্ব বহন করতে হয়। বেতন না পেলে মেয়ের কলেজের টাকা দিতে পারবো না, তাতে আমার মেয়ের ওপর প্রভাব পড়বে। কোনো অপরাধ না করেও শুধুমাত্র তাদের জি হুজুর না বলায় আমার এ দশা। আমি সব চিন্তা করে শামীম সাহেবের রুমে গিয়ে দু-হাত করজোর করে বললাম, ‘আমার কোনো দোষ থাকলে ক্ষমা করে দিন।’ তারপর তিনি একটি কাগজ এনে একটা চিঠির মতো লিখে, তার অভিযোগ প্রত্যাহার করলে আমার বেতন পরের মাসে চালু হয়।

নিয়মিত অনুসন্ধানী সংবাদ আমার নেশা। ঠিক এ কারণে প্রায় বিভিন্ন শ্রেণীর অপরাধীদের সঙ্গে মিশতে হয়। গম কেলেংকারী নিয়ে মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে সংবাদ পাঠালাম, ছাপানো হলো না। চিনিকলে কোনো কোটি কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে কিছুদিন এক নাগারে অনুসন্ধান করে তথ্য উপাত্তসহ সংবাদ পাঠালাম, ছাপা হলো না। ঠাকুরগাওয়ের সকল মাদক ব্যবসায়ীর নাম ঠিকানা এবং কেন ও অর্থ যোগানদাতাদের নাম লিখে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণসহ সংবাদ পাঠালাম, ছাপা হলো না। ১২০টি ইটভাটা কেন, কীভাবে সরকারকে মুসক ফাঁকি দিচ্ছে? ৩ পর্ব পাঠালাম, ছাপা হলো না।

আজ ২৫ ডিসেম্বর রাতে কালের কণ্ঠের মফস্বল ডেস্কের রুবেল সাহেব ফোন করে বললেন, ‘আপনি অনেক নীতির কথা বলেছেন, সে যা হোক আপনাকে টার্মিনেট করা হয়েছে।’ বললাম কী কারণে? তিনি কোন কারণের কথা বললেন না।

আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন কালের কণ্ঠের শামীম সাহেব। কারণ তার নিজস্ব কিছু লোক আছে-যারা পুকুরে ইলিশ চাষ করেন, রাজনৈতিক নেতাদের তিনি কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এ নিয়োগ দিয়েছেন। আমার জেলা থেকেও তার লোকজন আছে, যারা বিতর্কিত কিন্তু তাদের প্রিয়।

রুবেল সাহেবের বন্ধু হলো স্পোর্টস রিপোর্টার রায়হান, রায়হানের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযোদ্ধার নেতার নির্বাচনে হেরে গিয়েছেন। ছেলে কালের কণ্ঠে চাকরি করে। আমার ওপর ভর করে কিছু কাগজপত্র দিলেন বর্তমান কমান্ডারের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। কেউ কাগজ ধরিয়ে দিলে, কোন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আমাকে সংবাদ লিখতে হবে। এজন্য কদিন ধরে অব্যাহত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, একদিকে রায়হান, অপরদিকে রায়হানের বাবা ও তার সহযোদ্ধারা। এমনকি নীতির কথা বলে আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললেন। সবকিছু ঠিকঠাক করে অফিসে নোট দিয়ে সংবাদ লিখলাম। ছাপা হলো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর।

আজ আমাকে রুবেল রাত ৯টার দিকে জানালো, আমাকে টার্মিনেট করা হবে। বিষয়টি চূড়ান্ত।

আমার ফেসবুক বন্ধুরা, আমি হলফ করে বলছি, সারাজীবন মানুষের জন্যই কাজ করেছি। এইতো মাত্র কদিন আগে, ফেসবুক বন্ধুদের কাছে সহায়তা গ্রহণ করে শীতার্তদের জন্য এগিয়ে গিয়েছি।

আজকের ফোনটি আমার সাংবাদিকতা জীবনের চরম একটা অপমান। অনেকে অপমান সইবার ক্ষমতা রাখে না। আমার নীতির উপহার যদি চাকরিচ্যুতি হয়, তবে কাল সকালে আমার সন্তানকে আমি কীভাবে মুখ দেখাবো? তাই সব ভাই-বোন-বন্ধুদের কাছে শেষ দিনের মতো ফেসবুকে আসলাম। আপনাদের অনেকের সঙ্গে অনেক হাসি রহস্য আর মানুষ ও মানবতহার গল্প, যুক্তিতর্ক হতো। সেখানে আমার কোনো ভুল থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার অপমান সইতে না পেরে আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।

কাপুরুষের মতো সবার দৃষ্টির বাইরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নাই। কারণ ওদের সঙ্গে লড়বো সে সামর্থ শক্তি আমার নেই। তবে বিচার দিয়ে গেলাম আমার মৃত্যুর জন্য কালের কণ্ঠের শামীম সাহেব, রুবেল সাহেব, রায়হান সাহেব মূল দায়ী।
তাদের কথায় সায় দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ আমাকে দেয়া হলো না। তাই মাননীয় সম্পাদক আমার মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। আপনারা আমার বন্ধু, ভালো বন্ধু। বিষয়টি আপনাদেরই জানালাম। বাইরে বসে আছি, ঠাণ্ঠা বাতাসটা বেশ ভালো, আফসোস স্বার্থান্বেষী মানুষগুলো মানুষের জন্য আমাকে কাজ করতে দিলনা। আমার কা-পুরুষতার জন্য সকল বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। মিলন সাহেবের স্বাক্ষরই আমার মৃত্যুদণ্ড। আমি এ দণ্ড গ্রহণ করলাম এবং যতক্ষণ পারি থাকবো। তবে রাত শেষ হবার আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। আমি ওই কাপুরুষদের ফোন নম্বর দিচ্ছি, আপনাদের এক একটি ফোনই আমার কাছে সান্তনার যে, বন্ধুরা ওই কাপুরুষ আর কলঙ্কিতদের ভৎসনা করেছে। বিদায় বন্ধুরা।

ভয় নেই সকাল বেলা আমার মৃত্যুর ঝুলন্ত ছবি আধুনিক টেকনলজির মাধ্যমে ঝুলন্ত দেখতে পাবেন। বিদায়। যাবার আগে বলছি, সব জায়গাতে প্রতারিত হয়েছি, ফেসবুক বন্ধুরা অনেক আপন ছিল আমার। ভালো থাকবেন। একটাই চাওয়া তাদের জন্য ঘৃণা, আর কাপুরুষের মতো চলে যাওয়ার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। ভালো থাকুন সবাই, মানুষের জন্য কাজ করে আমার মতো যন্ত্রণা যেন ভোগ করতে না হয়, এটাই কামনা।

যদি পারেন, আমার একমাত্র সন্তানের জন্য কেউ এগিয়ে আসবেন। তাকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা ছিল, সে যেনো মানুষের জন্য কাজ করতে পারে। তার জন্য দোয়া করবেন, সে যেনো আমার অকাল প্রয়াণ সইবার ক্ষমতা রাখে।

সূত্রঃ বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই