উল্টো ফেঁসে গেলো নাইকো
বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া এদেশে থাকা সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না কানাডীয় কোম্পানি নাইকো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত (ইকসিড) গত রোববার এই অন্তবর্তী আদেশ দেন। একই সঙ্গে ওই আদালত ফেনী গ্যাস ক্ষেত্রের পাওনা আটকে দেয়ায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে নাইকোর করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
পেট্রোবাংলা সোমবার ওই আদেশ হাতে পেয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে টেংরাটিলায় দুর্ঘটনার কারণে নাইকোর ফেনী গ্যাস ক্ষেত্রের পাওনা পরিশোধ স্থগিত ও তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায়ে ঢাকার আদালতে মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ। পেট্রোবাংলার পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জ করে ইকসিডে যায় নাইকো।’
২০১০ সালের জুলাইয়ে ইকসিডে মোট দুটি মামলা করে কোম্পানটি। একটি গ্যাসের বকেয়া বিল আদায় সংক্রান্ত (আরবি/১০/১৮)। অন্যটি টেংরাটিলা বিস্ফোরণে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত মামলা (আরবি/১০/১১)।
নাইকোর দাবি, তারা গ্যাস বিল বাবদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে ২৭ দশমিক ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা রয়েছে। কিন্তু সেই বিল বাংলাদেশ সরকার পরিশোধ করছে না। বিল পরিশোধের নির্দেশনা চাওয়া হয়। অথবা সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে বাংলাদেশকে।
অন্য দাবি হচ্ছে, ‘টেংরিটিলা বিস্ফোরণ বাবদ বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, যার কোনো বৈধতা নেই।’ এছাড়া তারা এদেশে তাদের স্থাবর-অস্থাবর বিক্রির অনুমতি চায়।
ইকসিড দু’টি মামলাকে একিভূত করে একই সঙ্গে বিবেচনায় নেয়। এরমধ্যে সম্প্রতি নাইকো ইকসিডে আরেকটি আবেদন করে। সেটিতে তারা বাংলাদেশে তাদের সম্পত্তি বিক্রিতে অনুমতি চায়। আর আংশিক আকারেও হলে গ্যাস বিল বাবদ পাওনা ক্ষতিপূরণসহ দ্রুত পরিশোধের নির্দেশনা চেয়েছিল কানাডীয় কোম্পানিটি।
ইকসিড তাদের এ আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেছে ডিসেম্বরে অধিকতর শুনানি শেষে রায় না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়টি স্থগিত থাকবে। আর বাংলাদেশ সরকার ও পেট্রোবাংলার লিখিত অনুমতি ব্যাতিত শেয়ার হস্তান্তর বা সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রি করে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছিল নাইকো। কিন্তু পেট্রোবাংলা সায় না দেয়ায় তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারছিল না।
সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে নাইকোর সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট (জেভিএ) সই করে বাপেক্স। নাইকো বাপেক্সকে সঙ্গে নিয়ে ফেনী ও ছাতক ক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পায়। নাইকোর সঙ্গে জেভিএ করতে ওই দুই গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্তও দেখানো হয়। দুই ক্ষেত্রের অপারেটর হিসেবে নাইকো গ্যাসের ৮০ শতাংশ এবং বাকি ২০ শতাংশের মালিকানা পায় বাপেক্স।
ফেনীতে সফলভাবে গ্যাস উৎপাদন শুরু হলেও অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাস ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটে। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়ে যায়। এছাড়া পরিবেশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পদের ক্ষতি হয়।
জানা গেছে, দু’টি বিস্ফোরণে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষতি বাবদ নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে সরকার। কিন্তু নাইকো বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি।
টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের দায়িত্ব এড়াতে নাইকোর বিরুদ্ধে তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফকে ঘুষ দেয়ারও অভিযোগ ওঠে। ওই বছরের মে মাসে তাকে প্রায় দুই লাখ ডলার দামের একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুইজার উপঢৌকন দেয় নাইকো। ২০১১ সালের জুনে কানাডার আদালতের কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছে তারা।
এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ বাবদ মন্ত্রীকে ৫ হাজার ডলার দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয় স্বীকারোক্তিতে। কিন্তু সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে ২০১২ সালের ২ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোশারফের বিরুদ্ধ এই অভিযোগে একটি অভিযোগ দাখিল করে।
এদিকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ আইনজীবীদের সংস্থা বেলা ঢাকায় উচ্চ আদালতে নাইকোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যৌথ চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ এবং দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবিতে কানাডীয় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বাংলাদেশ সরকারের ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত ফেনী ক্ষেত্রের গ্যাসের মূল্য পরিশোধ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন। এরপর নাইকো পাওনা দাবি করে হাইকোর্টে যায়। হাইকোর্টও রায় না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের মূল্য পরিশোধ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন। আর ঘটনার তিন বছর পর ২০০৮ সালে যুগ্ম-জেলা দ্বিতীয় জজ আদালতে মামলা করে পেট্রোবাংলা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকার আদালতে মামলা দায়েরের পর থেকেই নানা বাহানায় নাইকো শুনানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বার বার সময় চাওয়া হচ্ছে। উল্টো ২০১০ সালের জুলাইয়ে নাইকো ইকসিডে বাংলাদেশ ও পেট্রোবাংলাকে অভিযুক্ত করে দু’টি মামলা করে। পরে ইকসিড এক আদেশে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে মামলার অভিযোগ থেকে বাদ দেয়। আর রোববার আরেকটি অন্তবর্তীকালীন আদেশ দিয়েছেন।
মন্তব্য চালু নেই