উপকূলে এখন শুধুই রোয়ানুর ক্ষতচিহ্ন

ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উপকূলবাসীর। ঘটেছে প্রাণহানি, হয়েছে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। ঝোড়ো বাতাসে উপড়ে পড়েছে শত শত গাছ। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং অনেক স্থানে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। রোয়ানু চলে গেলেও রয়ে গেছে তার ক্ষতচিহ্ন।

শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম উপকূল দিয়ে স্থলভাগে উঠে আসে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। বৃষ্টির কারণে বিকেল নাগাদ দুর্বল হলেও গাছ ও বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৪ জন।

চট্টগ্রাম : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রামে। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনা। বন্ধ হয়ে যায় বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম।

প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর রোববার সকাল থেকে বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে রোয়ানুর আঘাতে পার্বত্য রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার জাতীয় গ্রিডের ৩৩ হাজার কেভি ভোল্টের একটি টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়ে পুরো জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। কাপ্তাই-ঘাঘড়া সড়কে পাহাড়ি ঢলের কারণে একটি সেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় রাঙামাটির সঙ্গে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

কাপ্তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী আশফাকুর রহমান মুজিব জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে কাপ্তাইয়ে ৩৩ হাজার কেভি লাইনের একটি বড় বৈদ্যুতিক টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে অনেক গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কক্সবাজার : কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় ঘর ও দেয়াল চাপা এবং নৌকার ধাক্কায় তিনজনের মৃত্যু হয়। ঝড়ে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার সাড়ে ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ কোথাও আংশিক ও কোথাও সম্পূর্ণ ধসে গেছে। এ ছাড়া শতাধিক বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত এবং জেলার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।

বরিশাল : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে বরিশালের জনজীবন। ঝড়ের কারণে শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দক্ষিণাঞ্চল। ভারী বর্ষণের কারণে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ।

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শনিবার রাত থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ বা ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে।

চাঁদপুর : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে জেলার হাইমচর ও মতলব উত্তর উপজেলার ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ । ঝড়ে চর ঈশানবালা এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ চর এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

নোয়াখালী : জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচরের বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত এলাকায় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। চারদিকে তলিয়ে যাওয়ায় গবাদিপশুর খাবার নিয়ে বিপাকে পড়েছে মানুষ।

পটুয়াখালী : পটুয়াখালী-বরগুনাতে অন্তত পাঁচ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলার চর মোন্তাজ, চর বেষ্টিন, লালুয়া, নিজামপুর, দেবপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাউফল উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ১৩৪টি কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গলাচিপায় ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় অন্তত দেড় শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গলাচিপার চর লতা ও চালিতাবুনিয়ার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

অপরদিকে বরগুনা সদর উপজেলার মাঝের চর, ডেমা, গুলিশাখালী, মানিকখালী, লবণগোলা, নাপিতখালী, পূর্ব বুড়িরচর, বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ কালিকাবাড়ি, আলিয়াবাদ, উত্তর কালিকাবাড়ি, ভোড়া, বেতমোড়, উত্তর বেতাগী, আমখোলাসহ অন্তত ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

ঝালকাঠি : নদীর পানি বেড়ে জেলার চার উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ৫ হাজারেরও বেশি পরিবার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বরগুনা : ঘূর্ণিঝড়ে বিষখালী, পায়রা ও বলেশ্বর নদীতীরের সোনাতলা, কাটাখালী, গাবতলী, নলটোনা, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া, তালতলীর তেঁতুলবাড়িয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৪৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এসব এলাকার বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে কৃষিজমি ও মাছের ঘের। ঝোড়ো বাতাসে অসংখ্য গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক সড়কের ওপর গাছ উপড়ে পড়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে যান চলাচল। বিদ্যুৎ নেই জেলার অধিকাংশ এলাকায়।

ভোলা : ভোলার মনপুরায় রোয়ানুর আঘাতে সামিয়া নামের তিন দিনের এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। প্রবল ঝোড়ো হওয়ায় শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। এ ছাড়া ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ৫-৬ ফুট জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। এতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। রোয়ানুর প্রভাবে ভোলার ইলিশা এলাকায় মেঘনা নদীতে বালুভর্তি দুটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। এতে চারজন নিখোঁজ হন।

মনপুরায় কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মনপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন বেড়িবাঁধহীন কলাতলীর চর ও চর নিজাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই সময় চরাঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় মানুষ উঁচু মাটির কিল্লা ও ঘরের চালে আশ্রয় নেয়।

বিচ্ছিন্ন চর নিজামে রেড ক্রিসেন্টর মাঠকর্মী জসিম জানান, ৬-৭ ফুট জোয়ারের পানিতে চর নিজাম তলিয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় ক্ষতিগ্রস্তরা মাটির কিল্লায় আশ্রয় নেন।

দুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আকতার চৌধুরী বলেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।

খুলনা : রোয়ানুর প্রভাবে খুলনায় সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে দুটি নদীর বেড়িবাঁধ। প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসন সতারখালি ও তিলডাঙ্গা এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ১৬০টি পরিবারের তালিকা করেছে। ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার শরাপপুর বাঁধ ভেঙে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে।

বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করেছে। তবে শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর তীরবর্তী বেড়িবাঁধের তাফালবাড়ি পয়েন্টের কয়েকটি স্থানে ফাটল ও ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

2 5 download 1



মন্তব্য চালু নেই