ইসি ও নির্বাচন নিয়ে ফের সক্রিয় বিদেশিরা

রাষ্ট্রপতির বেঁধে দেয়া দশ দিনের মধ্যেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সদস্যদের নাম সুপারিশ করতে গতকাল শনিবার (২৮ জানুয়ারি) আনুষ্ঠানিভাবে কাজ শুরু করেছে সার্চ কমিটি। সকাল ১১টায় সুপ্রিমকোর্ট জাজেস লাউঞ্জে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেছিলেন এ কমিটির সদস্যরা। সার্চ কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শনিবার তাদের প্রথম বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে নিজেদের কাজের কৌশল তারা ঠিক করেছেন। সেইসঙ্গে গত দুই দিনে নিজেরা কী চিন্তা করেছেন সেগুলো পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করেছেন।

তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে ‘নিরপেক্ষ সদস্য’ খুঁজে বের করাটা সার্চ কমিটির জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কর্মপরিধি নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সার্চ কমিটিকে। কারণ সময় সংক্ষিপ্ততার জন্য জনসম্পৃক্ততার সুযোগও রাখা হয়নি। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন কেউ কেউ। সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।

এদিকে কে হচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং কমিশনের সদস্য হিসেবেই বা কারা থাকছেন, এ নিয়ে সব রাজনৈতিক মহলে চলছে জোর আলোচনা। এদের কয়েকজন জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না।

এদিকে সার্চ কমিটি, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে নানা রকম তৎপরতা শুরু করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। তারাও এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করতে চান। আবার এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই জাতিসংঘেরও। আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে চায় এ সংস্থা। এ লক্ষ্যে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়েছে। ফলে দেশি-বিদেশি কূটনীতিক থেকে শুরু করে দেশবাসী সাধারণ মানুষ সবার দৃষ্টি এখন এই সার্চ কমিটির দিকে।

তবে শুরুতেই নানা বিতর্কের মুখে পড়েছে এই নবগঠিত সার্চ কমিটি। এ দফার সার্চ কমিটির সদস্যদের নির্বাচনে ২০১২ সালের জিল্লুর রহমানের ফর্মুলা, এমনকি প্রধান ব্যক্তিটিকেও হুবহু অনুসরণ করায় এটা একরকম স্পষ্ট হয়েছে যে, ৩১টি রাজনৈতিক দলকে এ নিয়ে বঙ্গভবনে ডাকা হলেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কারো প্রস্তাব আমলে নেননি।

অন্যদিকে গতবারের সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাঁচটি করে নাম নিয়েছিল। সেই তালিকার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের তালিকা মিলিয়ে রাষ্ট্রপতিকে কমিশন গঠনে দশজনের একটি তালিকা সুপারিশ করেছিল। গতবার বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফা এক দাবিতে থাকায় তারা কোনো তালিকা দেয়নি। আর এবার তারা তাদের নির্বাচন কমিশন গঠনের রূপরেখাতে বাছাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কর্মকর্তাদের ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি জানিয়ে রেখেছিল। তাদের রূপরেখাই সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ১০টি করে না নিয়ে অভিন্ন নামের তালিকা প্রস্তুত করতে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিন্ন নাম না পাওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যেতে বলেছে। এসব কিছুই অনুসরণ না করায় বিএনপির তোপের মুখে পড়েছে সদ্য গঠিত এই কমিটি।

ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা সার্চ কমিটিকে স্বাগত জানালেও ‘সরকারের পছন্দের লোকের কমিটি’ আখ্যায়িত করে এই কমিটিকে নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি। এর তীব্র নিন্দা করে এই কমিটি কোনো নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে পারবে না বলেও মত প্রকাশ করেছেন দলটির একাধিক নেতা। গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান তারা।

সার্চ কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে সারাদেশের মানুষের সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ নেই। তাই দশ দিন যথেষ্ট সময় বলেই মনে হয়। অন্যদিকে সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত নামের তালিকা প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু প্রণীত নামের ওপর গণভোট হওয়ার সুযোগ নেই, তাই নাম প্রকাশ না করাই ভালো।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ কমিটিতে কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন, যারা নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন। তিনি আরো বলেন, যে তালিকাটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে, সেই তালিকাটি যেন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যথাযথভাবে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যতটা সহযোগিতা করা দরকার, ততটা সহযোগিতা তাদের করতে হবে। সবচেয়ে বড় সহযোগিতা আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। তারা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে অবশ্যই তা হবে।

এদিকে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তাদের পুরনো প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে চায়। একই সঙ্গে তারা কারিগরি সহায়তা দেয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পরামর্শও নিতে চায়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মিলছে না। তবে প্রতিনিধিদলটি আশাবাদী, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য তারা রাষ্ট্রপতির সময় পাবে।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এবং আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনস বলেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। এর অংশ হিসেবে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে চাই।’

তিনি বলেন, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। এটা ইতিবাচক দিক। প্রক্রিয়াটি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করেছেন, এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী বলেন, ‘আমরা জানি, রাষ্ট্রপতি সবচেয়ে কঠিন ও ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। এক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ দেবেন। আমাদের এ কমিটি পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর রাষ্ট্রপতি গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরো বিষয়টি স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখছেন।’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে ওয়াটকিনস বলেন, ‘এ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভবিষ্যতে প্রক্রিয়াটি কীভাবে অগ্রসর হয় সেটা দেখার পর সিদ্ধান্ত নেব।’

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আগেই ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে বিদেশি কূটনীতিকদের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাতের জন্য রাষ্ট্রপতির সময় চায়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে যে ক’জন বিদেশি কূটনীতিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছেন, তারা হলেন- মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোন, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার নিব্লেট, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আলিসন ব্লেইক ও কানাডার হাইকমিশনার পিয়েরে লাঘামে।

এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের এমন আগ্রহকে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। নিজেদের সংবিধান ও আইন দিয়েই যে কোনো সমস্যার সমাধান হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিদেশিদের কথায় চলার মতো অবস্থায় বাংলাদেশ আর নেই। ওই দিন চলে গেছে। বিদেশিদের কথায় চলার মতো মেরুদণ্ডহীন নয় বাংলাদেশ। একই বিষয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা সবসময়ই বলেছি- কীভাবে আমাদের নির্বাচন হবে, কীভাবে গণতন্ত্র চলছে, কীভাবে আমরা চলব- এগুলো আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের সংবিধান আছে, আইন আছে। আমরা সেভাবেই দেশ পরিচালিত করব।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন গঠন ও আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে জাতিসংঘের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘের দেওয়া চিঠি প্রসঙ্গে বলেন, সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে বিএনপি। জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নেয় আমরা সব সময়ই তাকে স্বাগত জানাই। গতবারও জানিয়েছিলাম। এবারও জানাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নেয়, সরকার তার আশপাশ দিয়েও যায় না। এ সময় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহব্বান জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের দূতিয়ালি নতুন কিছু নয়। জাতীয় নির্বাচনসহ যে কোনো টানাপড়েনে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে সবসময়ই তাদের তৎপরতা দেখা গেছে। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বেশ কয়েকবার ঢাকা সফর করেন। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে গুলশানে একটি বৈঠক করেন তিনি। যদিও দুই দলের প্রধান দুই নেত্রীর অনুপস্থিতির সেই বৈঠক তৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে খুব বেশি সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারেনি।



মন্তব্য চালু নেই