ভালো নেই বায়েজিদ বোস্তামির কাছিমগুলো

ইচ্ছামতো খেয়েদেয়ে এখন ওদের মরণদশা

শান বাঁধানো বিরাট পুকুর। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ভিড় করেছেন ঘাটে। কারও হাতে পাউরুটি আর কলা-মুড়ি। কারও হাতে মাছ-মাংস। খাবারগুলো শলার মাথায় গেঁথে খুব যত্ন করে সবাই খাওয়াচ্ছেন পুকুরে থাকা বেশ কিছু কাছিমকে। খাওয়ানোর সময় অনেকে কাছিমগুলোর শরীর-মাথায় আদর করে হাত বুলাচ্ছেন, ছুঁয়ে দেখছেন। খাবার ও আদর পেয়ে কাছিমগুলোও যেন ভীষণ সন্তুষ্ট। চট্টগ্রামের হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) মাজারের পুকুরঘাটে এমন দৃশ্য নিত্যদিনের। মাজার জিয়ারত ও কাছিমগুলোকে খাবার খাওয়াতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিনই আসছেন অসংখ্য মানুষ।

বোস্তামীর কাছিম নামে পরিচিত এ কচ্ছপগুলোকে জীববৈচিত্র্যের অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ বায়েজিদ বোস্তামীর (রহ.) মাজারের পুকুরে বসবাসকারী এ প্রজাতির কাছিম বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। বোস্তামীর কাছিমগুলোকে স্থানীয়ভাবে গজারি-মাদারী নামে ডাকা হয়। স্থানীয় বা এনডেমিক প্রজাতির এ কাছিমের বৈজ্ঞানিক নাম নিলসোনিয়া নাইগ্রিক্যান্স। বিরল প্রজাতির এই কাছিমগুলো এখন মরণদশায় কাটাচ্ছে দিনকাল।

‘হজরত বায়েজিদের কাছিমগুলোকে খাওয়ালে পুণ্য হয়, মনের আশা পূরণ হয়’_ এমন বিশ্বাসের কারণে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষ বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার জিয়ারত করার

পাশাপাশি কাছিমগুলোকেও সাধ্য মতো খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও কাছিমগুলোর ভীষণ কদর। যারা কাছিমগুলোকে খাওয়াতে পারেন তারা নিজেদের ‘সৌভাগ্যবান’ মনে করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে খাওয়ানোর কারণে কাছিমগুলোর জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। একটি কাছিম যে পরিমাণ খেতে পারবে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি খাওয়ানো হচ্ছে প্রতিদিন। খাবারের বড় একটি অংশ পানিতে মিশে দূষণ ঘটাছে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। এ জন্য দেখা দিচ্ছে রোগব্যাধি। প্রজননের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কমছে বংশবৃদ্ধিও। তাই বিপন্ন কাছিমগুলোকে রক্ষায় উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের প্রাণী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘বোস্তামীর কাছিমগুলো এখন সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। জীববৈচিত্র্যের মূল্যবান সম্পদ কাছিমগুলো রক্ষা করা না গেলে যারা এখন মানত করে সেগুলোকে খাওয়াচ্ছেন, তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। যারা এসব খাবারের ব্যবসা করছেন তাদের সে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কাছিমগুলো রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দুর্লভ প্রজাতির বোস্তামী কাছিমের দুটি নমুনা থেকে প্রাণিবিজ্ঞানী এন্ডারসন ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম বোস্তামী কাছিমের প্রজাতিটি রেকর্ড করেন। ওই দুটি নমুনা ছিল চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী পুকুর থেকে সংগৃহীত কাছিমের। ১৯১২ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী এন এনানডেল বোস্তামী কাছিম এক সময় ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে বিচরণ করত বলে দাবি করলেও পরে তিনি সে ধারণা থেকে সরে আসেন। ১৯১৪ সালে এনানডেল ও প্রাণিবিজ্ঞানী এম শাস্ত্রী এক গবেষণায় উলেল্গখ করেন, বোস্তামী কাছিম শুধু চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন পুকুরেই পাওয়া যায়।

বোস্তামী কাছিমগুলো মাজারে আগত ভক্ত ও পর্যটকদের দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভরশীল। কাছিমগুলোকে সাধারণত পাউরুটি, কলা, গরুর ফুসফুস, মাংস এবং মুড়ি খেতে দেওয়া হয়। যদিও পাউরুটি, কলা কিংবা মুড়ি এ প্রজাতির কাছিমের খাদ্য নয়। তাই গরুর ফুসফুস বা মাংস পেলে কাছিমগুলো অন্য খাবার খেতে চায় না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাজারে আগত পর্যটকরা প্রতিদিন গড়ে ৪৭ কেজি পাউরুটি, ৩১২টি কলা এবং ৬৩০ গ্রাম ফুসফুস কাছিমগুলোকে খাবার হিসেবে দিচ্ছেন। ফলে কাছিমের খাবার বিক্রির জন্যই মাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকানপাট।

গত সপ্তাহে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, পুকুরঘাটে বসে শলার মাথায় কলা গেঁথে কাছিমগুলোকে খাওয়াচ্ছেন নগরীর সদরঘাট থেকে আসা শিখা রানী নামে এক ষাটোর্ধ্ব নারী। তিনি বলেন, ‘মানত পূরণ করতে গজারিগুলোকে খাওয়াতে নাতি-নাতনিদের নিয়ে এসেছি। খাওয়াতে পেরে আনন্দ লাগছে।’

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গহিরা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাজারে আসা শারমিন আকতার নামে অপর এক নারী বলেন, ‘মাজারে এসে প্রথমে জিয়ারত করেছি। এখন গজারিগুলোকেও খাওয়াতে পেরেছি। আশা করি মনের আশা পূরণ হবে।’

বোস্তামীর পুকুর পরিদর্শনকালে দেখা যায়, বোস্তামীর কাছিমগুলোকে ভক্তরা ইচ্ছে মতো খাওয়াচ্ছেন। তবে এর বড় একটি অংশ পুকুরে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কলা ও রুটিতে সাদা হয়ে আছে পুকুরের আশপাশ। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলা-রুটি কাছিমের খাবার নয়।

চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, কাছিমগুলো রক্ষায় ভক্তদের নিয়ে আসা খাবার সংরক্ষণ করে সেখান থেকে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে দুই থেকে তিনবার করে কাছিমগুলোকে খাওয়ানো উচিত। এ ছাড়া খাওয়ানোর সময় পুকুরে যেসব খাবার ছড়িয়ে পড়ে সেগুলো নেটের সাহায্যে তুলে নেওয়া দরকার যাতে পানির গুণগত মান ও পরিবেশ ঠিক থাকে।



মন্তব্য চালু নেই