ইকোনমিস্টের চোখে বাংলাদেশের সহিংসতা

হত্যাকারীরা এসেছিল কুরিয়ার কোম্পানির কর্মী হিসেবে। সন্দেহ উদ্রেককারী পাঁচ-ছয় জনের একটি দল। ২৫শে এপ্রিল ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে তাদের বহন করা পার্সেলের প্যাকেট ছিল চাপাতিতে ভরা। বাসায় প্রবেশ করেই তারা সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধুকে হত্যা করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হত্যার জন্য দায়ী করেছেন বিরোধীদলীয় জোটকে। খবর-মা,জ,অ

কয়েক ঘণ্টা পর আরও আপাতগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যখন আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় একটি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে নেয়।সমকামী ও হিজড়া পাঠকদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম ম্যাগাজিন ‘রূপবানের’ সম্পাদক ছিলেন জুলহাজ। তিনি ইউএসএইডেও কর্মরত ছিলেন। এ মাসের শুরুতেই সমকামী ও হিজড়া তরুণদের নিয়ে ‘রঙধনু র‌্যালি’র আয়োজনের চেষ্টা করার পর থেকেই তিনি মৃত্যুর হুমকি পেয়ে আসছিলেন (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে জানিয়ে পুলিশ ওই র‌্যালি বাতিল করে দেয়)।

এ মাসেই একই কায়দায় খুন হলেন চারজন উদারপন্থি। জুলহাজ হত্যার দুই দিন আগেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন অধ্যাপককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তাও আবার প্রকাশ্য দিবালোকে। আইএসের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে, এমন দাবি করা একটি দল ওই হামলার দায় স্বীকার করে। গত বছর একই ধরনের হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন বুদ্ধিজীবী, ব্লগার বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। অধ্যাপকের মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় সন্দেহভাজন হিসেবে মৌলবাদী দলের এক সদস্যকে আটক করা হলেও এসব অপরাধের কোনোটির জন্যই কাউকে দণ্ডিত করা হয় নি।

শেখ হাসিনা বলেছেন, আপত্তিকর মতামত প্রকাশ করেন এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সংঘটিত ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’র কোনো দায় তার সরকার গ্রহণ করবে না। ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান হেফাজতে ইসলামের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। কট্টরপন্থি ইসলামিক এ দলটি প্রধানমন্ত্রীর দলের সমালোচনা করতো। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্রের দুর্বল প্রতিক্রিয়ার কারণেই হত্যাকাণ্ডগুলো গতি পাচ্ছে। ব্রাসেলস-ভিত্তিক এনজিও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশের ‘ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবিত ও অকার্যকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

সরকারের এই প্রতিক্রিয়ার শেকড় বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে প্রোথিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ে তোলে। কিন্তু কয়েকটি অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ক্ষমতায় কয়েক দফা সামরিক শাসকদের অধিষ্ঠিত করে, যা দেশে ইসলামের সমর্থন বিস্তৃতিতে সহায়ক হয়। সামরিক শাসকদের একজন ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। পরের বেসামরিক সরকারগুলোও নিজেদের বৈধতাকে ধরে রাখতে গিয়ে ইসলামের ব্যবহারকে অব্যাহত রাখেন। পর্যাপ্ত জনসমর্থন না পাওয়া (২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ) শেখ হাসিনা ধর্মীয় রক্ষণশীলদের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ছেন। মার্চ মাসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট দুই মিনিটে খারিজ করে দেন একটি আদালত।

বিরোধী দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আংশিকভাবে উল্টোপথে ধাবিত হচ্ছে। তারা ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধান ইসলামিক মিত্রদল জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের কারণ দলটির নেতাদের ফাঁসির বিরুদ্ধে এখন আর প্রতিবাদ জানায় না বিএনপি (ফাঁসি কার্যকর ব্যাপক সমর্থন পেয়ে আসছে)। বিএনপির ক্ষমতা কাঠামোতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী গয়েশ্বর রায় উঠে এসেছেন ওপরের দিকে, যা মাত্র এক বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রীয়াজ বলেন, ‘একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের মৃত্যুগাঁথা এখনই লেখাটা হয়তো বেশি আগেভাগেই হয়ে যাবে।’ তবে, একই কথা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে বলা যায় না।

বৃটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ‘ক্যাম্পেইন অব টেরর এগেইন্সট বাংলাদেশ ‘স লিবারেল ভয়েসেস’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ



মন্তব্য চালু নেই