ইউরোপে যখন ‘মধ্যযুগ’, মুসলিমদের তখন স্বর্ণযুগ
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট আয়োজন করেছে ইসলামি শিল্পকলার ওপর একটি জমকালো প্রদর্শনী অনুষ্ঠান। ২৭ এপ্রিল শুরু হয়েছে অনুষ্ঠানটি; চলবে ২৪ জুলাই পর্যন্ত। মূলত মুসলিমদের সেলজুক শাসনামলের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্যই এ আয়োজন। এগারো শতক থেকে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত পুরো মধ্য এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শাসন করেছে সেলজুক মুসলিম সাম্রাজ্য। ইউরোপের রোমেও সালতানাত স্থাপন করেছিল সেলজুকরা।
এমন একটা সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামি সভ্যতা বিষয়ক এ আয়োজন চলছে যখন দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইসলামভীতির সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি মুসলিমরা। আয়োজকরা জানান, সেলজুক শাসনামলের প্রায় ২৭০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে অনুষ্ঠানে। এর মধ্যে আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থেকে সরকারি ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা সিরামিকের সামগ্রী, কাঁচের সামগ্রী, চিত্রকর্ম, কাঠের শিল্প, টেক্সটাইল এবং বিভিন্ন ধাতব দ্রব্য থাকবে প্রদর্শনীতে।
এছাড়া সেলজুক শাসনামলে বিজ্ঞান গবেষণার উদ্দেশ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, ধর্মচর্চা এমনকি অন্তেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্যও থাকবে প্রদর্শনীতে।
নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটন অঞ্চলের রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গেলে এখন যে বিষয়টি সবচেয়ে শুনতে হয় তা হলো: আসন্ন মার্কিন নির্বাচন প্রসঙ্গে রিপাবলিকান প্রার্থীদের বিভিন্ন বিদ্বেষমূলক মন্তব্য সংক্রান্ত আলোচনা; বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য সংক্রান্ত নানা মন্তব্য। ঠিক এমন একটি স্থানেই ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগের একটি প্রদর্শনী চলছে। আসলে এ কারণেই একেকটি জাদুঘরে হচ্ছে সংস্কৃতির একেকটি স্বর্গ।
জাদুঘরটির প্রদর্শনী কক্ষে ঢুকলেই দেখা যাবে, সেলজুকদের ইতিহাস ঐতিহ্যের নানা উপাদান। সভ্য দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক শাসন করেছিল সেলজুকরা। সেই ভূমধ্যসাগর থেকে চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল- সবটাই ছিল সেলজুক সাম্রাজ্য। ওই সময়ের ইতিহাসের বিভিন্ন বই, চিকিৎসা শাস্ত্রের নানা গ্রন্থ নজরকাড়া প্রাসাদ, মসজিদ এবং অনেক দূর্গের নানা চিত্রকর্ম দেখানো হচ্ছে প্রদর্শনীতে। সন্দেহ নেই এগুলো আপনাকে অভিভূত করবে। এক সময়ের এই শক্তিশালী সভ্যতাটির কথা বর্তমান সময়ে মানুষ অনেকটা ভুলে গেলেও নতুন এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আবার সেলজুকদের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইউরোপে মূলত যে সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, ‘মধ্যযুগ’ বলে গালাগাল দেয়া হয়; সে সময়টা ছিল মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ। পাশ্চাত্য যখন অজ্ঞতা আর মূর্খতার কারণে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, প্রাচ্য তখন জ্ঞানের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। ইউরোপের মানুষ যখন ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, খ্রিস্টান চার্চের নির্যাতনে জর্জরিত, মুসলিম বিশ্বে ধর্মই তখন নিয়ে এসেছিল শান্তির সুবাতাস। মহাত্মা গান্ধীও এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘পাশ্চাত্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আর্ত পৃথিবীকে তা দিলো আলো ও স্বস্তি।’
ইউরোপের ইতিহাসে চতুর্থ থেকে পঞ্চদশ শতককে ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, ইউরোপের ‘অন্ধকার যুগ’। অষ্টম শতকে ইউরোপে সামন্ত ভূস্বামী, গোত্র অধিপতি ও যাজকদের প্রাধান্য ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে তেমন কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব ছিল না। আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি’ দ্বারা সমাজ পরিচালিত হতো। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিচারব্যবস্থা ছিল না। ছিল না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মধ্যযুগের শুরুতে অবশ্য ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম-যাজকেরাই জ্ঞানের আলো ছড়াতে কিছু অবদান রাখেন। তারা এ সময় রোমান সাম্রাজ্যের অনেক ভালো জিনিস গ্রহণ করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে শাসকেরা কলহ-বিবাদে দুর্বল হয়ে পড়লে যাজকরা রাজ্যশাসনে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তারা কর আদায় থেকে শুরু করে এবং জীবনের সর্বেক্ষেত্রে তারা প্রাধান্য বিস্তার করে। এরপর থেকে যাজকরাও শুরু করে অত্যাচার। ওই সময়টায় ইউরোপের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩০ বছর।
অষ্টম শতকের শুরুর দিকে মুসলিমরা ইউরোপে প্রবেশ করে। ইসলামি সভ্যতার সংস্পর্শে আসে ইউরোপের জাতিগুলো। এ সভ্যতাকে তারা বলতো আরব সভ্যতা। আবার অনেকে বলতো ‘মুহম্মদীয় সভ্যতা’। এই সভ্যতার প্রভাবেই একটা সময়ে অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের স্বপ্ন দেখে ইউরোপের মানুষ। সেখানে তারা সংঘটিত করে ইউরোপীয় রেনেসাঁ। অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসে ইউরোপ।
মন্তব্য চালু নেই