‘আব্বু তুমি চোখ বন্ধ করো না’

স্বামীকে কেড়ে নিয়েছো, আমি সারাজীবন আমার দুই সন্তান নিয়ে থাকতে চাই, আমি ওদের ভিক্ষা করে খাওয়াবো, তুমি আমার সন্তানদের কেড়ে নিও না, আমার কোল খালি করে দিও না খোদা…এভাবেই কখনও বুক চাপড়ে, কখনও একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়ে, আবার কখনও সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের সুস্থতা কামনায় দুই হাত তুলে বিলাপ করছিলেন মনি।

এদিকে দুই শিশুর চিকিৎসার স্বার্থে শনিবার (২৫ জুন) সকালে গঠন করা হয়েছে আট সদস্যের এক মেডিক্যাল বোর্ড।

উত্তরা ট্রাজেডিপাশে থাকা মাকে মনি বলছিলেন, এখানে যখন নিয়ে আসি মাইশা বলছিল, আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে, আর কতদূর হাসপাতাল। মেয়েটা আমার ছটফট করছিল, কিচ্ছু করতে পারিনি। বাবার চোখ বন্ধ দেখে বাবাকে ধাক্কা দিয়ে বলছিল- আব্বু তুমি চোখ বন্ধ করো না।

উল্লেখ্য, উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারের লিফট ছিঁড়ে আগুনের সূত্রপাত হলে সেই আগুনে দগ্ধ হন মাহমুদ হাসান রিপন এবং তার সঙ্গে থাকা দুই সন্তান।

আজ সকাল ছয়টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে শরীরের ৮৮ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রিপন মারা যান। আর বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে (হাই ডেফিসিয়েন্সি ইউনিট) রয়েছে তার দুই সন্তান ১১ বছরের মেয়ে মেহনাজ হাসান মাইশা আর নয় মাসের শিশুপুত্র মুনতাকিন হাসান।

এইচডিইউ’তে থাকা দুই সন্তানের আরোগ্য কামনায় ইউনিটের বাইরে বসে বিলাপ করছিলেন মা মনি।
হাসপাতালে উপস্থিত মাহমুদ হাসান রিপনের এক আত্মীয় বলেন, মাইশা সকালে বলেছে- খালামনি, বাবা তখনো উঠে আসতে পারে নাই, গায়ে আগুন লেগে গেছে, হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করছিল বের হয়ে যাওয়ার জন্য।

বিল্ডিং ভেঙে পড়াতে আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি, হাতে ব্যথা পেয়েছি কিন্তু মুনতাকিনকে ছাড়ি নাই, ওরে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আমি বের হয়েছি।

উত্তরা ট্রাজেডি২০০৪ সালে বিয়ে করেন প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান রিপন ও মনি। তাদের দুই সন্তান এবং ছোট সন্তানটির জন্ম আমেরিকায়। গত ডিসেম্বরে তারা দেশে আসেন বলে জানান রিপনের মামা আব্দুর রব।

তিনি জানান, গতকাল শুক্রবার আলাউদ্দিন টাওয়ারের বেজমেন্টে অবস্থিত ট্রপিক্যাল হোমসের অফিসে ইফতারের আয়োজন ছিল। রিপন এই কোম্পানিতে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

দুই সন্তানকে নিয়ে ইফতার করতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর থেকে আগেই বের হন রিপন, পরের রিকশায় এসেছেন রিপনের বাবা ও স্ত্রী। মনি বলেন, তারা রিকশা থেকে নামতেই দেখেন পুরো ভবনটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, কিন্তু তখনো জানতাম না, আমার সব শেষ হয়ে গেছে সেই ধোঁয়ায়।

আজ সরেজমিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত এইচডিইউ ইউনিটের সামনে বসে আছে নিহত মাহমুদ হাসান রিপনের দুই মামা সুলতান বাদশা, আব্দুর রব, শাশুড়ি শিমু বেগমসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন।

কিছুক্ষণ পরই এইচডিইউ থেকে সন্তানদের দেখে বেরিয়ে এলেন মা মনি। দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানদের জীবন ভিক্ষা চাইছিলেন। আর মনির আহাজারিতে ভারি হয়েছে সেখানে উপস্থিত সবার চোখ, আত্মীয় না হয়েও অনেকেই সৃষ্টিকর্তার কাছে শিশু দুটির প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন।

বলছিলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি কী এমন অন্যায় করলাম যে খোদা আমার সব কেড়ে নেবে…আল্লাহ তুমি আমার দুই বাচ্চারে ফিরিয়ে দাও খোদা…এসময় স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন।

মনি বলছিলেন, আমার ওতটুকু ছেলেকে এত কষ্ট দিচ্ছে কেন খোদা, ওত কোনও অন্যায় করেনি।
মনি বলছিলেন, স্বামী ও দুই সন্তানকে তিনি নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। পাশে থাকা স্বজনকে জড়িয়ে বলছিলেন- আমার মুনতাকিনের গায়ে কিছু ছিল না, আমি ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এসছি, আমি যেন ওড়না দিয়ে পেঁচিয়েই তাকে নিয়ে বাসায় যেতে পারি।

কাঁদতে কাঁদতে মনি বলেন, রিপন তাকে মারা যাওয়ার আগে বলেছেন, ‘আমি চোখ খুলতে পারছি না, আমি তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না, তোমাদের জন্য কিছু করে যেতেও পারলাম না, তুমি আমার সন্তানদের দেখে রেখো আর আমাকে মাফ করে দিও।’ আমি তাকে আর শেষ দেখা দেখতে পারলাম না, ওকে নিয়ে গেল।

উল্লেখ্য, নিহত মাহমুদ হাসানের ময়নাতদন্ত শেষ করে এরইমধ্যে তাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ি বগুড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মাইশার শরীরের প্রায় ৪৫ শতাংশ আর মুনতাকিনের শরীরের প্রায় ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর যেকোনও শিশুর যদি ১০ শতাংশ পুড়ে যায় তাহলেই তাকে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি।

শিশু দুটি আশঙ্কামুক্ত নয় মোটেই বললেন ডা. সেন। তিনি বলেন, এ ধরনের যে বার্ন নিয়ে রোগীরা আসেন তাতে আমরা চিকিৎসকরা অসহায় হয়ে যাই, অনেক সময় আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেই, কিন্তু কোথাও কোথাও আমরাও পারি না কিছু করতে।

আর এই দুর্ঘটনাগুলো এভাবে কেন ঘটবে সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। লিফট ভেঙে পড়া, সিলিন্ডার ব্লাস্ট এ বিষয়গুলো খুব সহজেই প্রতিরোধযোগ্য ঘটনা। কিন্তু কাদের গাফিলতিতে এসব ঘটছে সেদিকে এবার নজর দিতে হবে।

ঢাকা শহরের শপিংমলগুলোতে কয়টা লিফট মনিটর করা হয় সেটাও দেখা দরকার। ছয় মাস পর পর কর্তৃপক্ষের উচিত এসব রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া, আর সময় নষ্ট করা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে শনিবার সকালে ৮ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামকে প্রধান করে ডা. সামন্ত লাল সেন, বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক ডা. মো সাজ্জাদ খোন্দকার, বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়াল, নেফ্রোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, শিশু বিভাগের অধ্যাপক ইফফাত আরা সামশাদ, মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ আহম্মেদ এবং বার্ন ইউনিটের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহ আলম ভুঞাকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ড। -বাংলা ট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই