আওয়ামী লীগ নেতারাও বেচাকেনা করছেন বোমা

সরকার পতন আন্দোলনে ব্যবহৃত বোমা তৈরি, বেচাকেনা ও নিক্ষেপকারীর তালিকায় বিএনপি-জামায়াত জোটের পাশপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামও রয়েছে। সারাদেশে অন্তত ৯০ জন সরকারদলীয় পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ‘নাশকতায়’ সহযোগিতা করছে। এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।

দলীয় কতিপয় নেতাকর্মীর অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়। এতে বলা হয়— এ সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থানিতে হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্যের আমদানি প্রতিরোধে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিতে বলা হয়। এ ছাড়াও লাইসেন্সধারী বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানিকারকদের আমদানি ও বিক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য সরকারের উচ্চ মহলে জানানো হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, প্রতিদিন অন্তত কয়েকশ’ হাতবোমা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। এ সব হাতবোমায় কাঁচামাল হিসেবে সালফার ডাই-অক্সাইড, ফসফরাস, এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ডিডিটি, টিএনপি, লেড-অক্সাইড, লেড-এ্যাজাইড, মারকারি, গন্ধক, পটাশিয়াম সালফেট ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সব বিস্ফোরক অবৈধভাবে সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারি ও ক্রেতার কাছে ‘মসলা’ নামে পরিচিতি। এ সব দ্রব্যের আশি ভাগ ভারত থেকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সরকারবিরোধীআন্দোলনে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অবৈধ বিস্ফোরক দ্রব্যের তৈরি বোমা, ককটেল ব্যবহার করে সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এ সব ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, এমপি, প্রশাসনের কর্মকর্তাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের ওপর হামলা চালানো হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে, অবৈধ বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানি ও সরবরাহের সঙ্গে ২১৬ জন জড়িত। এদের মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয়ের ৫৩ জন, জামায়াত-শিবিরের ২৪ জন ও আওয়ামী লীগের ২৫ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির একজন ও সুবিধাবাদীসহ অন্যান্য ব্যক্তি রয়েছেন ১২০ জন।

বোমা কিংবা ককটেল তৈরিতে সারাদেশে ৩২১ জন জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।এদের মধ্যে বিএনপির ১৬০ জন, জামায়াত-শিবিররের ৯০ জনও আওয়ামী লীগের ২৬ জন। সুবিধাবাদী ও অন্যান্য ৪৫ জন। সারাদেশে তৈরি করা বোমা বা ককটেল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ৩৬৬ জন। এদের মধ্যে বিএনপির ১৫৮ জন, জামায়াত-শিবিরের ১০৬ জন ও আওয়ামী লীগের ৪০ জন। এ ছাড়া সুবিধাবাদীসহ আরও ৬২ জন ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ্য করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এ প্রতিবেদক অবৈধ বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানি ও সরবরাহ, বোমা-ককটেল তৈরি এবং কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের ৯০ নেতাকর্মীর মধ্যে ৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে। তারা হলেন— কুষ্টিয়ার মো. রওশনের ছেলে আবু তৈয়ব বাদশা। বর্তমানে তিনি কুষ্টিয়া সদর থানা যু্বলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধঘোষিত চরমপন্থী সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ রয়েছে। একই জেলার চৌড়হাঁস এলাকার আনিছুর রহমানের পালিত ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাবার নাম আবদুল খালেক। একই জেলার খোকসা উপজেলার চরপাড়া গ্রামের মিরাজ হোসেনের ছেলে বাপ্পী বিশ্বাস রাজু বিস্ফোরক দ্রব্য চোরাচালন ও আমদানি সরবারহ কাজে জড়িত রয়েছেন। তিনি বর্তমানে খোকসা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে রয়েছেন। আগে তিনি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলেন। একই উপজেলার রতনপুর গ্রামের গুলজারের ছেলে ওহিদুল ইসলাম জুয়েল খোকসা উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে তিনিও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে। জেলার মিরপুর‍ উপজেলার নওদা গোপালপুর গ্রামের মফিজ ব্যাপারীর ছেলে রবিউল ইসলামও একই কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন। রবিউল ইসলাম বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগের আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ২০১৩ সালের আগে নিষিদ্ধঘোষিত চরমপন্থী সংগঠনের সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি গোপনে চরমপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার আবদুর রহমান সরদারের ছেলে এটিএম আক্তারুজ্জামানও এ সব বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানি ও সরবরাহ করে থাকেন। আক্তারুজ্জামান বর্তমানেবুধহাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে ফেনী সদর উপজেলার পূর্ব উকিলপাড়া গ্রামের দিদারুল আলমের ছেলে জিয়াউল আলম মিস্টার একই কাজে জড়িত রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। আগে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। একরাম হত্যা মামলায় বর্তমানে মিস্টার কারাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের হাজী সামসুল আলম সিকদারের ছেলে জহিরুল ইসলাম সিকদারের বিরুদ্ধেও বোমা বেচা-কেনার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানি ও সরবরাহকারী হিসেবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নাম থাকা প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার বুধহাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এটিএম আক্তারুজ্জামান বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। জামায়াত-শিবির আমার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সহায়তা করার প্রশ্নই আসে না। জামায়াত-বিএনপির কিছু লোক আমাদের দলে ঢুকে আমার সম্পর্কে এমপি-মন্ত্রীর কান ভারি করছে।

বোমা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত হিসেবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটির তালিকাভুক্ত কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সহিংসতায় কোনো সহায়তা করছি না। যদি কেউ কোনো অভিযোগ করে থাকে তারা তাদের স্বার্থে এ অভিযোগ করেছে।

চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টিও অস্বীকার করেন রবিউল ইসলাম।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নিজের নাম থাকা প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন  বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে কেউ এ অভিযোগ করেছে। যে সব কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে কোনো দিনই আমি জড়িত ছিলাম না, এখনো নেই।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম থাকা প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম মর্তুজা খসরু  বলেন, আমার জেলার ছাত্রলীগের কোনো সদস্যের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক নেই। আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামুন ছাত্রলীগের ছেলে। তার বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ সত্য নয়। ছাত্রলীগের কেউ বোমা হামলা বা বোমা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত নয়।

এ সব বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম  বলেন, জামায়াত-বিএনপির হাতবোমা তৈরি করার বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তবে আওয়ামী লীগের কেউ যদি এমন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসী কিংবা বোমা হামলাকারী ও বিস্ফোরক কেনাবেচাকারীর কোনো দল নেই। তাদের পরিচয়— তারা অপরাধী। সে যে দল কিংবা আদর্শের হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই