আওয়ামী লীগের সম্মেলনে খালেদাই ‘প্রধান অতিথি’!
মিজানুর রহমান খান : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে টেলিফোনে জানতে চাইলাম, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে আপনারা যাচ্ছেন কি না? বললেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি সন্ধ্যা নাগাদ জানাবেন আশা করছি।’ আমাকে একটুও অবাক না করে তিনি বললেন, জ্যেষ্ঠ নেতারা এই আমন্ত্রণের বিষয়ে খুবই ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তিনি।
বেগম খালেদা জিয়ার সামনে আবারও একটি বিরাট সুযোগ এসেছে। তাঁর উচিত হবে মির্জা ফখরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে উপস্থিত হওয়া। মধ্যম সারির কোনো প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সারার সময় এটা নয়। অবশ্য কোনো প্রতিনিধি না পাঠানো হবে গণতন্ত্রবিরুদ্ধ, এমনকি আত্মঘাতী।
বিএনপিকে ভাবতে হবে সামনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। সুতরাং আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার যেকোনো প্রক্রিয়ায় বিএনপির উচিত হবে সম্পৃক্ত হওয়া।
আর জাতীয় রাজনীতি কোনো কালেই কোনো দেশেই কখনোই বদ্ধ জলাশয় হওয়ার নয়। এটা অন্তর্গতভাবে পরস্পরবিরোধী এবং প্রধানত কম যুক্তিসংগত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৈশভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করা, টেলিফোনে বাদানুবাদ করা, আরাফাতের বিয়োগান্তক মৃত্যুর পরে শেখ হাসিনাকে প্রধান ফটক থেকে বিদায় দেওয়া এবং সর্বোপরি ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করা, এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক দেখেছে জনগণ। এবং এর বেশির ভাগ সম্পর্কেই বিএনপির মধ্যে প্রবল মত হলো, শেখ হাসিনা তাঁর নৈশভোজ কিংবা আরাফাতের মৃত্যুর পরে দেখা করার বিষয়ে ‘আন্তরিক’ ছিলেন না। রাজনীতি ছিল তাঁর মুখ্য। এই মতের প্রবক্তারা অবশ্য অস্বীকার করতে পারেন না যে, সেই কথিতমতে লোকদেখানো রাজনীতি শেখ হাসিনাকে কিছু সুবিধা দেওয়া ছাড়া অন্তত বেকায়দায় ফেলেনি। বিএনপি বিব্রত হয়েছে।
উন্নত গণতন্ত্রেও কিন্তু লোকদেখানো রাজনীতিরও একটা মূল্য আছে। হিলারি-ট্রাম্প টিভি বিতর্কের শেষ পর্বটিতে তিক্ততা এত বেশি মাত্রায় তীব্রতা পেয়েছিল যে, সেটা শুধু একটা বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। তাঁরা এদিন করমর্দন করেননি। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি যে তাঁরা টিভি বিতর্ক বয়কট করবেন। নারী-বিষয়ক টেপ-গেট কেলেঙ্কারির পরে ট্রাম্পের ‘রিয়েলিটি শো’ আরও উপভোগ্য হয়েছে। কিন্তু মাইক বন্ধ বা লাইভ সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটেনি। ট্রাম্প-হিলারির মধ্যকার যে ‘ব্যক্তিগত বিদ্বেষ’ সারা বিশ্ব দেখেছে, সেটা কি একেবারেই প্রকৃত বাস্তবতা? আমার কিন্তু তাতে সন্দেহ আছে। দুই প্রার্থীর বাগাড়ম্বরের অনেক উপাদানই লোকদেখানো। প্রথম দুই পর্বে উভয়ে উভয়ের প্রতি উদ্ভাসিত হাসিমুখে করমর্দন করেছেন। সেটা কি লোকদেখানো ছিল না? কিন্তু সেটা তাঁরা যে করতে পেরেছেন, তাতে আমেরিকান গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ম্লান হয়নি, উজ্জ্বল হয়েছে।
আমি জানি, বাংলাদেশ রাজনীতির ধর্ম ও সংস্কৃতি খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ সমর্থন করে না। সারা বিশ্ব থেকে ৫৫ জন অতিথি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আসবেন। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম যে খালেদা জিয়া গেলে তিনিই হয়ে উঠবেন মিডিয়ার প্রধান আকর্ষণ, সেটাই হবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মূল খবর। কারও ঘোষণার দরকার নেই, তিনি অঘোষিত প্রধান অতিথি বা মধ্যমণি গণ্য হবেন! আর তাঁকে বক্তৃতা দিতে দেখা গেলে তো গিনেস বুকে নতুন এন্ট্রি যুক্ত হবে!
জানি এটা হবে না। কিন্তু এ-ও ঠিক কোনো না কোনো দিন পারস্পরিক অনাস্থার চলমান ধারা বদলাতে হবে। যদি নতুন প্রজন্ম একটি সহনশীল গণতান্ত্রিক ধারাকে ‘সকল উন্নয়নের ভিত্তি’ মনে করে, তবে রাজনীতির বর্তমান ধারাকে তারা অচল হিসেবেই দেখবে।
আজ সকালেই এ বিষয়টি নিয়ে আমি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা নূহ-উল আলম লেনিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি।
তাঁরা উভয়ে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, অতীতে বিভিন্ন সময়ে পরস্পরকে তাঁরা তাঁদের কাউন্সিলে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে শেখ হাসিনাকে বিএনপির কাউন্সিলে বা বেগম খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কখনো দেখা যায়নি।
তবে ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিএনপির কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর অংশগ্রহণ অনুমোদিত ছিল।
উভয় দলের প্রতিনিধিরাই এর আগে পরস্পরের কাউন্সিলে গেছেন। কিন্তু বিএনপির প্রতিনিধি বক্তৃতা দেননি বা সেই সুযোগ পাননি। অসীম কুমার ইতিহাসের একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি আওয়ামী লীগার হয়ে বিএনপির সম্মেলনে অতিথি বক্তা হয়েছেন। অবশ্য অসীমকে সে জন্য দলে তাঁকে সমালোচিত হতে হয়েছে। তিনি তাঁর বক্তৃতায় জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে তাঁদের যুগপৎ আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। অসীমকে মূলধারার নেতা বলা কঠিন। কারণ দলের সহ-প্রচার সম্পাদক পদে একাদিক্রমে তাঁকে তিন মেয়াদে স্থির থাকতে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় রাজনীতি এখন বেশ কম আশাবাদের জায়গা। কিন্তু তার মধ্যেও একটা দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে রাজনীতিতে একটা নতুন আশাবাদের খবর এসেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ তাদের গত সম্মেলনে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানায়নি। এটা লোকদেখানো হলেও এর গুরুত্ব যে অসামান্য তার প্রমাণ আওয়ামী লীগকে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরেছে। বিএনপি কিন্তু গতবারের আগের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলমের সঙ্গে আমি একমত যে বিএনপি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিলে তা বাংলাদশ রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
মির্জা ফখরুল স্মরণ করেছেন যে, আওয়ামী লীগ তাঁদের গত ১৯ মার্চের সম্মেলনে আসেনি। কিন্তু সেটা মনে রেখে তাঁদের বয়কট ঠিক হবে না। সামনে যেতে হবে। সার্বিক বিচারে আমি আশা করব, বেগম খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলই ব্যক্তিগতভাবে যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগ নির্দিষ্টভাবে দুই শীর্ষ নেতাকে দাওয়াত দিয়েছে। প্রতিনিধি পাঠানো কিন্তু প্রটোকলে পড়ে না।
অনেকে বলবেন ২০১৩ সালের সেই নৈশভোজ কবে তামাদি হয়ে গেছে। আমি বলব, প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজের আমন্ত্রণ বাসি হয় না। কারণ সেটা ছিল রাজনৈতিক নৈশভোজ। তাই সেখানে সময় চলে যাওয়ার কোনো ব্যাপার থাকতেই পারে না।
নৈশভোজের দাওয়াত তো দিলেন, কিন্তু সময়টা কখন তা কখনো বলেননি, শেখ হাসিনার আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়ে খালেদা জিয়া তো সহাস্যে এই প্রশ্ন রাখতেই পারেন!-প্রথম আলো থেকে নেওয়া।
মন্তব্য চালু নেই