অস্তিত্ব টেকাতে লড়ছে জামায়াত

চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়ছে বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংবাদ সংস্থা এএফপি।

‘বাংলাদেশ বিসিজড জামায়াতে ইসলামি পার্টি ফাইটস ফর ইটস লাইফ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাটি লিখেছে, “বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি রাজনৈতিক দলটি এখন তার অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য লড়ছে। ইতিমধ্যে দলটির অনেক নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। দলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। আর প্রধান শরিক দল তাদের থেকে দূরে অবস্থান করছে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে মুসলিমপ্রধান দেশে যখন ইসলামপন্থীদের উত্থান হচ্ছে, তখন জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান স্থবির হয়ে যাচ্ছে। কারণ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভূমিকার কলঙ্ক থেকে দলটি বের হয়ে আসতে পারেনি। সম্প্রতি দলটির আধ্যাত্মিক নেতা কারাগারে আটক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। নেতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দলকে নির্জীব করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘জামায়াত এখন এক পায়ের ওপর ভর করে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছে।”

নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, “নতুন দল গঠন করা ছাড়া জামায়াতের সামনে আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।দলটির জন্য নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা জনগণকে নিজেদের সমর্থনে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে এবং একাত্তরের দায় থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।”
অধ্যাপক আতাউর বলেন, “দলটি যত তাড়াতাড়ি এ বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য তা তত কল্যাণকর হবে।”

স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে ছোট শরিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকার গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে আসছে। এই উত্থানকে থামিয়ে দিতে গত বছর সাধারণ নির্বাচনে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি রায়ে বিচারক জামায়াতকে নির্বাচনে নিষিদ্ধের রায় দেন।

এ রায়ের পর জামায়াতের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়। এমনিতেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির প্রধান সারির নেতাদের বিচার শুরু হওয়ায় নেতাকর্মীদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত রয়েছে।

গত জানুয়ারিতে বিএনপির বয়কট করা নির্বাচন এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে দেয়া রায়ের প্রতিক্রিয়ায় গত বছরে চলা সংঘর্ষে প্রায় ৫০০ লোক প্রাণ হারায়। আর ওই বিক্ষোভ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ট্রাইব্যুনালের দেয়া প্রথম রায়ের পর জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে রাজপথে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। কিন্তু কয়েক দিন আগে আপিল বিভাগে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির নেতাকর্মীদের বিক্ষোভে তেমন উত্তেজনা দেখা যায়নি। এমনিক গত সপ্তাহে ডাকা হরতালেও বিক্ষোভের আঁচ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দেশটির ট্রাইব্যুনাল অক্টোবর মাসেই জামায়াতের প্রধান মাওলানা মতি্উর রহমান নিজামী ও অর্থের জোগানদাতা এক নেতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। রায়ের পর বিক্ষোভের ঘটনা দেখা গেলেও তা গত বছরের তুলনায় কিছুই না।

সরে গেছে মিত্ররাও
জামায়াত ইস্যুতে দূরে অবস্থান করছে জোটের প্রধান শরিক বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। অথচ বিএনপিই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে একসময় সরকার গঠন করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া রায়গুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি বিএনপি। এমনকি জামায়াতের প্রধানকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়েও চুপ ছিল দলটি।

গত মাসে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের আধ্যাত্মিক নেতা গোলাম আযমের মৃত্যুতেও কোনো শোকবাণী পাঠায়নি বিএনপি। আর এটি দুই দলের সম্পর্কের দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, “বিএনপি এটা অনুধাবন করেছে যে, যদি তারা জামায়াতের নেতাদের অব্যাহত সমর্থন দিতে যায়, তাহলে তাদের ভোটারদের বড় একটি অংশের ভোট হারাতে হবে।”

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াত ইসলামাবাদ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হওয়ার বিরোধিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের একটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছিল দলটি।

শেখ হাসিনা সরকার বলছে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। আর তার জন্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া দরকার। যুদ্ধের পর গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। তার দল জামায়াতকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়ার পরও গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এবং তার দলকে পুর্নগঠিত করেন। নব্বইয়ের দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালুর পর জামায়াত সরকার গঠনে ‘কিংমেকারের’ ভূমিকা পালন করে।

গত নির্বাচনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পর থেকেই সংগঠনটির নেতৃত্ব এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখে পড়ে। গ্রেফতার এড়াতে দলটির বেশির ভাগ নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন। কয়েক মাস ধরে দলটির নতুন নেতা ডা. শফিকুর রহমানকেও দেখা যাচ্ছে না।

যুদ্ধাপরাধ নিয়ে লেখালেখি করা বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, “জামায়াত তাদের ১৯৭১ সালের ভূমিকার খেসারত দিচ্ছে। দলটি ১৯৭১ সালে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রসংগঠনের নেতাদেরই নেতৃত্বে বসিয়েছে।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেছেন “নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে হলে জামায়াতের নতুন নেতৃত্বকে অবশ্যই একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।”

আত্মগোপনে থাকা জামায়াতের এক মুখপাত্র সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, “নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পরই অনেকে মনে করেছেন জামায়াতের মৃত্যু হচ্ছে।” তবে নেতাদের মৃত্যুদণ্ড এবং নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞার রায় দলটিকে খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে করেন তাহের।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে তাহের বলেন, “এ ট্রাইব্যুনালের বিচার লজ্জাজনক। কিন্তু আমরা প্রতিবাদও করতে পারছি না। পুলিশকে বলে দেয়া আছে, বিক্ষোভ মাত্রই যেন গুলি করা হয়।”

তাহের বলেন, “জামায়াত পুনরায় তার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। দলের নেতাকর্মীরা সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে ভালো ফল করেছেন।”



মন্তব্য চালু নেই