অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী খাদিজা
কোনও বখাটে যখন কোনও নারীকে হয়রানি করে, তখন প্রচলিত সমাজ সাধারণত ওই নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সিলেটের খাদিজা আক্তার নার্গিসকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত ধারণা বদলে গেছে। বুধবার এই মামলার একমাত্র আসামি বদরুল ইসলামের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা রায়ে উল্লেখ করেন, ‘খাদিজা অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী।’
আদালত বলেন, ‘নারীরা এখন আর বেগম রোকেয়া কথিত অন্দরমহলের অবরোধবাসিনী নন। তবে এখন নারীরা অরক্ষিত। নারীরা পদে পদে নিগৃহীত, হত্যা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এজন্য আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতা দায়ী।’ আদালত আরও বলেন, ‘প্রেম চিরন্তন। প্রেমে মিলন, বিরহ থাকবেই। কিন্তু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এমন পৈশাচিক ও নৃশংস আচরণ কাম্য নয়।’
৩০ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, ‘খাদিজা অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী।’ চাপাতির নৃশংসতায় ক্ষতবিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মৃত্যুর কাছে হার না মানা বিশ্ব নারীসমাজের প্রতিভূ।’ আর কোনও বখাটে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করবে না উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘‘বদরুলের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি আরোপের মাধ্যমে ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হাজার হাজার উত্যক্তকারী ভবিষ্যতে’ এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে।’
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী। বর্তমানে দেশে বিচারপতি, পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে নারীরা গৌরবের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। দেশের গার্মেন্টস খাতে নারীদের পরিশ্রমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সর্বস্তরে নারীরা সাফল্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নারীরা এখনও অরক্ষিত, নির্যাতিত। খাদিজার ওপর নৃশংস হামলাই প্রমাণ করে নারীরা কতটা অরক্ষিত।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, ‘এ ধরনের বিচার সমাজে বখাটেদের সাবধান বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করে রাখবে।’ এবার বাংলায় রায় হওয়ার বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, `অহরহ বাংলায় রায় হচ্ছে বিচারিক আদালতে। এ কারণে রায়গুলো মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাচ্ছে। এটা ভালো।’
নারীনেত্রী খুশী কবীর বলেন, ‘খাদিজা বেঁচে গিয়ে নিজের কথাগুলা বলতে পেরেছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা টেকেনি। কিন্তু যারা সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হন, তাদের বেলা হুট করে মেয়েটাকে দোষারোপ বন্ধ হওয়া জরুরি।’
এ বিষয়ে আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘নারীর প্রতি যে সহিংসতা তার ঘৃণ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বদরুল। সে নার্গিসকে কোপানোর পর আবার প্রেমের দোহায় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সমাজ নার্গিসকে একেবারেই দোষারোপ করতে পারেনি তার প্রতি বদরুলের সহিংসতা দেখে।’ তিনি বলেন, তনুর ক্ষেত্রে একই রকমভাবে সহিংসতা ঘটরেও সমাজ উল্টো তনুর দোষ খোজার চেষ্টপা করেছে। কিন্তু জনরোষের মুখে নার্গিসের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় নি। এই ধরনের দ্রুত বিচারগুলো আশান্বিত করে, কিন্তু সবকেত্রে দ্রুত বিচার না হওয়াটা শঙ্কারও সৃষ্টি করে। ’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর সিলেট এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম। এ ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা বদরুলকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে বদরুলকে একমাত্র আসামি করে মামলা দায়ের করেন। গত বছরের ৫ অক্টোবর বদরুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই বছরের ৮ নভেম্বর নার্গিস হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার এসআই (সাবেক) হারুনুর রশীদ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ১৫ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট গৃহীত হয়। ২৯ নভেম্বর আদালত বদরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
মন্তব্য চালু নেই