অভিজিৎ হত্যা: শহুরে তারুণ্য ও মানবিকতা

মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে টিএসসির জনাকীর্ণ এলাকায় নিহত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি একটি পাশবিক হত্যাকাণ্ড। মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান চর্চা আর প্রগতিশীল চেতনার উপর একটি বড় ধরনের আঘাত এ হত্যাকাণ্ড। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে জাতি একজন মেধাবীকে হারিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু কেবল একজন মানুষের চলে যাওয়া নয়, এ মৃত্যু আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দুইজন যুবক অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায়। এসময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর জখম হন। আর এর পরের চিত্রটি আমাদের ইট-কাঠের শহরে ক্রমশ মানবিকতা শূন্য বাস্তবতার ঘৃণ্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন রাস্তার ফুটপাতে রক্তাক্ত অভিজিৎ রায় পড়ে ছিলেন। এ রক্তাক্ত মানুষটাকে দেখতে চারপাশে অনেক তরুণ ভীড় করেছেন। রাফিদা আহমেদ বন্যা সবার কাছে কিছু একটার অনুরোধ করছেন। ছবি দেখে এটা স্পষ্ট, একজন মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য তার স্ত্রীর আহ্বান কি হতে পারে।

অবাক করা বিষয়, নিথর পড়ে থাকা অভিজিৎ রায়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন একজন পুলিশ সদস্য, অন্তত জনা-বিশেক তরুণ। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি অভিজিৎকে টেনে তুলতে। অভিজিৎ রায় কোনো ছোঁয়াছে রোগে মারা যাননি। তিনি হামলার শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। এ শহরের বাইরে কোনো গ্রামে এ ঘটনা ঘটলে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়- মানুষের জন্য মানুষের হাত প্রসারিত হতো। কিন্তু ঢাকা শহরে যত মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়, মনুষ্য প্রজাতির জন্য তা আরো দর্শনীয় হয়ে ওঠে।

তাই বইমেলা সংলগ্ন এলাকায়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আঙ্গিনায় যখন এমন ঘটনা ঘটে, তখন আমাদের তারুণ্য আর মানবিকতা মানুষের রক্ত দেখতে আসে। এ রক্ত দেখে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কেউ সব দেখেও কিছু দেখা হয়নি ভঙ্গিতে আরো রক্ত দেখতে চায়, কেউ সব দেখেও কিছু দেখিনি ভঙ্গিতে চলে যায়। কিন্তু মানবিক দায়বোধ এ বিছিন্নতার নগরের নাগরিকদের তাড়া করে না।

শেষ পর্যন্ত গুরুতর জখম হওয়া রাফিদা আহমেদ একাই টেনে তুলার চেষ্টা করেন অভিজিৎ রায়কে। এসময় প্রথমে এগিয়ে আসেন সে মানুষ, যিনি খুব সম্ভবত একজন ফটো সাংবাদিক, অন্যজন বই হাতে মেলা থেকে ফিরছিলেন। এক হাতেই পালন করেন মানবিক দায়িত্ব।

এ শুধু তাৎক্ষণিক ঘটনা প্রবাহের কিছু বর্ণনা। একটি অস্বাভাবিক ঘটনায় মানুষ অপ্রস্তুত হতে পারে, ভীত হতে পারে। কিন্তু শুক্রবার দিনভর যে তরুণেরা অভিজিতের রক্ত দেখতে এসেছেন তারা কী করেছেন?
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন একজন পুলিশ সদস্য, অন্তত জনা-বিশেক তরুণ

দিনভরই ঘটনাস্থলে ভীড় করা অসংখ্য তরুণের একটাই কাজ ছিল মুঠোফোনে ছবি তোলা। কেউ সেলফি তুলেছেন কেউ ফটোসেশন করেছেন। এ তারুণ্য স্মৃতি কিংবা সাক্ষী হয়ে থাকতে চায়। সেখানে অভিজিতের মতো মানুষদের রক্ত তাদের ছবির গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। অভিজিতের রক্ত আবারও প্রমাণ করেছে, এ প্রজন্ম ঘটনার ততটুকুকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে, যা আগামী প্রজন্মের কাছে তার ছবির গুরুত্ব বাড়াবে।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড আমাদের বিবাদমান তারুণ্যকেও সামনে নিয়ে এসেছে। বিকারগ্রস্ততা কিংবা উগ্রতার মোড়কে এ সমস্যাকে সরলীকরণ করলে আমাদের আরো ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হতে হবে। কারণ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে প্রকাশ্যেই অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। যারা অভিজিতের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাদের লেখায়ও অনেকে তর্কে জড়িয়েছেন। এমনকি অভিজিৎকে কিভাবে হত্যা করা হবে, এমন পুরনো বিষয়ও ফেসবুকে উঠে এসেছে।

Avijit-Roy-1

ভাবতে অবাক লাগে এ ছোট শহরে, কিংবা হয়তো আমার গলিপথেই থাকে, এমন মানুষ এ ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন ফেসবুকে। এমন ফেসবুক ব্যবহারকারীর উগ্রতা একদিন আমাকে কিংবা অন্য আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারীকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

তাই এসব উচ্ছ্বাস কিংবা তর্ক এটাই ইঙ্গিত দেয়, আমাদের সাইবার জগতে হত্যার মতো ঘটনা ক্রমশ স্বাভাবিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি এখনই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করলে, সামনে আরো রক্তাক্ত অভিজিৎ দেখা অস্বাভাবিক ঘটনা হবে না।

এমন হত্যাকাণ্ডের পরও অগ্নিগর্ভ হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও এ ব্যস্ততার আধুনিকতায় কিছু মানুষ এসেছিলেন শাহবাগে কিংবা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদ জানাতে। প্রত্যেকের একটাই প্রশ্ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এ ধরনের ঘটনা কিভাবে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যখন ফেসবুকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করা হয় তখন পুলিশ তাকে আটক করতে পারে। কিন্তু যখন ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ অস্বাভাবিক নিরবতার রহস্য কি? এ আধুনিক নজরদারি কি কেবল রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার দাসত্ব নাকি নাগরিকের নুন্যতম নিরাপত্তায় ব্যবহার হবে?
রাফিদা আহমেদ বন্যা সবার কাছে কিছু একটার অনুরোধ করছেন

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড আমাদের রাজনৈতিক অন্তঃসারশূন্যতাকেও সামনে নিয়ে এসেছে। কারণ এ হত্যাকাণ্ডকে অন্য আর দশটি হত্যাকাণ্ডের মতো রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করলে চলবে না। এটা স্পষ্ট নয় যে কে অভিজিৎকে হত্যা করেছে, কিন্তু কোনো অপশক্তির যুথবদ্ধতা তাকে হত্যা করেছে তা স্পষ্ট। তাই বার্ন ইউনিট কিংবা মানুষ পোড়ানোর রাজনীতির সাথে একে এক করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু হবে না। এভাবে আসল হত্যাকারীগোষ্ঠীকে আড়াল করলে তা ভবিষৎকে আরো অন্ধকার করে তুলবে।

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড আমাদের গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট চেহারাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। কারণ, এ মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটিকে নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যম এমন প্রতিবেদন তৈরির চেষ্টা করেছে যা তার প্রতি মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলার শামিল। স্পষ্টত তারা ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছে, নয়তো অভিজিৎকে অপরাধী প্রমাণ করে এ হত্যাকে বৈধতা দেয়ার প্রবণতা এটি।

মস্তিষ্ক কেটে মানুষকে হত্যার এ সুচারু প্রদর্শনীর জন্য কোনো নিন্দাই যথেষ্ট নয়। শুধু এ কথা বলা যায়, মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে যেমন হত্যার মাধ্যমে থামিয়ে দেয়া যায় না তেমনি চেতনাকে ধ্বংস করা যায় না। আর এ ঘটনার পরও যদি সচেতন মানুষের বোধোদয় না হয়, কিংবা যারা নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন- সেটাও ভাবালুলতা মাত্র। কারণ নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

লেখক: সাংবাদিক
[email protected]



মন্তব্য চালু নেই