অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের প্রতি বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের কোনো স্থানে শান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টি হলে তা সমগ্র মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারব না।

শনিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে ভাষণকালে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের বৈধ রক্ষক হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকার প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশ সবধরনের সন্ত্রাসবাদ সহিংস চরমপন্থা, উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আমাদের রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর। তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়।’

স্থায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তাকে টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা অবস্থা এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বিশ্বের যেকোনো স্থানে শান্তি বিঘ্নিত হলে তা গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।’

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুসহ শত শত সাধারণ নাগরিক হত্যার তীব্র নিন্দা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের বৈধ সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৬৭-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে আল কুদস আল শরীফকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন এবং স্থায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের টেকসই সমাধান প্রত্যাশা করেন।

‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তাৎপর্যপূর্ণ শান্তি ও অহিংস সংস্কৃতির প্রস্তাবের ফলেই আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শান্তির পক্ষে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান আবারও সুদৃঢ় হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩৩ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছি।’

২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন অ্যাজেন্ডায় বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, এ নতুন কাঠামোয় টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। যেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বিভিন্নমুখী প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকবে।’

শেখ হাসিনা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন অ্যাজেন্ডায় স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ এবং সক্ষমতা সংশ্লিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের উপায় সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এই নতুন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি সমতাভিত্তিক, সমৃদ্ধশালী এবং টেকসই বিশ্ব গড়ার প্রত্যাশা পূরণের উপায় থাকতে হবে। যেখানে কোনো ব্যক্তি বা দেশ বাদ পড়বে না।’

আগামী বছরের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতির উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কিছু কিছু উন্নত দেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের সামষ্টিক জাতীয় আয়ের দশমিক সাত শতাংশ এবং ওডিএ হিসেবে জাতীয় আয়ের দশমিক দুই শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদান করায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, অধিকাংশ দেশই এখন পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। একইসঙ্গে বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোর জন্য ওডিএ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন এবং সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে আরও বেশি করে সমর্থন প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর বাজারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সব ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব আজ এক অভূতপূর্ব মানব চলাচল প্রত্যক্ষ করছে। বাংলাদেশ আজ বৈশ্বিক অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অন্যতম অংশীদার। আমাদের সামষ্টিক জাতীয় উৎপাদনে প্রবাসী আয়ের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে আমাদের লাখ লাখ অভিবাসী কর্মী দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। রেমিটেন্স ছাড়াও অভিবাসী এবং তাদের পরিবারবর্গ আমাদের অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য যে বহুমুখী অবদান রেখে চলেছেন, তার স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। সুতরাং ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন অ্যাজেন্ডার দলিলে অভিবাসনকে তার যথার্থ স্থান দিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এর আগে এই অধিবেশনে আমি উল্লেখ করেছিলাম, এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা ডুবে যাবে। তিন কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি জীবনমরণ সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের জন্য অভিযোজন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের জন্য পর্যাপ্ত এবং অতিরিক্ত অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত লাগসই-প্রযুক্তির পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিতে সহায়তা প্রয়োজন।’

তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় সাম কুতেসাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। একইসঙ্গে ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানের জন্য রাষ্ট্রদূত জন অ্যাস এবং মানবকল্যাণে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।



মন্তব্য চালু নেই